জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য বলছে, বিশ্ববাজারে টানা ১০ মাসের মতো বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতেও খাদ্যশস্যের দাম কমেছে। এর মধ্যে গম, ভোজ্য তেল, দুগ্ধজাত পণ্য ও চিনির দাম কমেছে। তবে বিশ্ববাজারে কমলেও দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম না কমে উল্টো বেড়েই চলেছে। এদিকে ডলার ক্রাইসিসে আমদানি কমে যাওয়া ও পণ্যের সরবরাহের সংকটের সুযোগ নিয়ে দেশের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ ভোক্তাদের। আর ব্যবসায়ীদের দাবি, কিছুদিন ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে এখন নিম্নমুখী। কিন্তু দেশীয় আমদানিকারকরা সবাই একযোগে কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যে কারণে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। মূলত নিত্যপণ্যের মধ্যে প্রধান ৬টি পণ্য আমদানিতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। এই ৬টি পণ্য হলো- গম, চিনি, সয়াবিন তেল, পাম তেল, ডাল ও সয়াবিন তেলের কাঁচামাল সয়াবীজ।
বিশ্ববাজারে যেসব পণ্যের দাম কমেছে: গত শুক্রবার এফএও জানায়, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমছে।
বিজ্ঞাপন
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর গত বছরের মার্চে খাদ্যপণ্যের দাম যেভাবে আকাশ ছুঁয়েছিল সে তুলনায় গত মাসে তা ১৮ শতাংশ কমেছে। বিশ্ববাজারে টানা ১০ মাসের মতো বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম কমলো। গত জানুয়ারি মাসে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক গড় দামের সূচক ছিল ১৩১.২ পয়েন্ট, যেটি ডিসেম্বরে ছিল ১৩২.২। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আগের মাসের তুলনায় খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে ০.৮ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে টানা দশম মাস কমেছে দাম। ভোজ্য তেল, দুগ্ধজাত পণ্য, চিনির দাম কমায় এই সূচক নিম্নগামী।
সংস্থাটি জানায়, অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়াসহ রপ্তানিকারক দেশগুলোর সরবরাহ বাড়ায় গমের দাম ২.৫ শতাংশ কমেছে। জানুয়ারিতে কমার মধ্যদিয়ে টানা তিন মাস নিম্নমুখী গমের বিশ্ববাজার। কিন্তু বাংলাদেশে এর বিপরীত চিত্র। দাম কমার বিপরীতে দেশে গমের দাম বাড়ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ডলার স্বল্পতায় গম আমদানিতে ব্যাংকগুলোর অর্থায়নে অনীহার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে গমের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৮৫ শতাংশই আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। বাকিটা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগে গত ফেব্রুয়ারির শেষদিকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতিটন গমের কেনা দর ছিল ৩০৭ ডলার। যুদ্ধ শুরুর পর সরবরাহ সংকট তৈরি হলে চারদিকে অস্থিরতা তৈরি হয়। এই অবস্থায় দাম হু হু করে বেড়ে ২০২২ সালের মে মাসে গমের দামে রেকর্ড অর্থাৎ টনপ্রতি ৪৬৫ ডলারে বিক্রি হয়। সেই যুদ্ধের এক বছর পর ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দামে ধস নেমেছে। এই সুযোগে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরাও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অনেক কম দামে গম কিনছেন। কিন্তু এর সুফল দেশের বাজারে মিলছে না।
এদিকে গমের দাম বাড়ায় গম দিয়ে তৈরি বেকারি পণ্যের দাম ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায় বেকারি এসোসিয়েশন। এর ফলে একটি ৫০০ গ্রামের পাউরুটি কিনতে আগে যেখানে ৬০ টাকা লাগতো, দাম বেড়ে গিয়ে সেটি ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হয়। একইভাবে আটা, ময়দা, সুজি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্যের দামও রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যায়। এখন গম আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কম দামে কিনলেও বেকারি পণ্যের দাম কিন্তু আগের বাড়তি দামই নেয়া হচ্ছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুলাই থেকে ৫ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট গম আমদানি হয় ১৫ লাখ ৪৬ হাজার টন। সরকারিভাবে এসেছে ৫ লাখ ১৩ হাজার টন। আর বেসরকারি উদ্যোগে এসেছে ১০ লাখ ৩২ হাজার টন।
এদিকে জানুয়ারিতে বিশ্ববাজারে ১.১ শতাংশ কমেছে চিনির দাম। অন্যদিকে চলতি মাসের প্রথম দিনই সরকার চিনির দাম বাড়ায়। বর্তমানে বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১০৭ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ১১২ টাকায়। অথচ দাম বাড়িয়ে দেশের চিনির বাজারে আসেনি স্বস্তি।
খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালত খুচরা ব্যবসায়ীদের ওপর চড়াও হলেও মিল মালিকদের মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। একদিকে সময় মতো চিনি না পাওয়া, অন্যদিকে জরিমানার ভয়ে বাজারে দেখা দিয়েছে চিনির ঘাটতি।
কাওরান বাজারের মুদি দোকানি হানিফ বলেন, সরকার বলেছে, খোলা চিনির দাম ১০৭ টাকা। অথচ আমাদের কিনতে হয় ১১০ টাকায়। প্রতিকেজি চিনিতে লাভ করি ২ টাকা। একদিকে ভোক্তাদের সঙ্গে বচসা, অন্যদিকে মোবাইল কোর্টের ভয়। এত ঝামেলা করে চিনি আনা যায় না।
এ ছাড়া জানুয়ারি মাসে গুঁড়াদুধ, বাটারসহ বিভিন্ন দুগ্ধপণ্যের দাম ডিসেম্বরের চেয়ে কমেছে ১.৪ শতাংশ, যা ১২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এফএও’র প্রধান অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমো টরেরো বলেছেন, দুটি অস্থির বছর শেষে খাদ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল হচ্ছে। এ অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
এফএও আরও জানায়, বিশ্ববাজারে জানুয়ারি মাসে ভোজ্য তেলের দাম কমেছে ২.৯ শতাংশ। নিম্নমুখী রয়েছে পাম, সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার এবং রেপসিডসহ প্রায় সব ধরনের ভোজ্য তেলের দাম। বর্তমান বাজারমূল্য এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম। আমদানিকারকদের কাছ থেকে চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় জানুয়ারিতে পাম তেলের দাম টানা দ্বিতীয় মাস কমেছে। চাহিদা কমেছে সয়াবিন তেলেরও।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ আমদানি করে এমন নিত্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে পাম তেলের দাম। টনপ্রতি এই দাম কমেছে ৭৭৫ ডলার বা ৪৪ শতাংশ। যুদ্ধের পর মার্চ মাসে যে পাম তেলের দাম উঠেছিল ১ হাজার ৭৭৬ ডলার, তা জানুয়ারি মাসে বেচাকেনা হয়েছে ৯৪২ ডলারে। দাম কমেছে সয়াবিন তেলের। গেল মে মাসে প্রতি টন সয়াবিন তেল বেচাকেনা হয়েছিল ১ হাজার ৯৬৩ ডলারে। জানুয়ারি মাসে তা ১ হাজার ৩৫১ ডলারে বেচাকেনা হয়। তাতে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি কমলো ৬১১ ডলার বা ৩১ শতাংশ।
কনজ্যুমাস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে কমানো হচ্ছে না। বিষয়টা দু:খজনক। তবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না, যাতে করে ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর আগে ভোজ্যতেল আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার ছাড়াও বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। আর ওই সুবিধা নিয়ে আমদানি করা তেল দেশের বাজারে আসলে দাম কমার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। মূলত ব্যবসায়ীদের অজুহাতের কোনো শেষ নেই।
আমদানিকারকরা নুরুল আলম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমলেও ডলারের দামে অস্থিরতা, ঋণপত্র খোলা নিয়ে ব্যাংকগুলোর অনীহা এবং মূল্য পরিশোধে জটিলতার কারণেই পুরোপুরি সুফল মিলছে না।
এদিকে গত রোববার আসন্ন রমজান মাসে দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্থিতিশীল হয়ে উঠে উল্লেখ করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, এ বছর থেকে একটা ওয়াদা দিতে পারি, রমজানের সময় দাম কমবে, বাড়বে না। মাসটিতে নিত্যপণ্যের মূল্য এবং সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ী, আড়ৎদার এবং মিল মালিকদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। ওই সভায় রমজান মাসে পণ্যের কোনো সংকট হবে না। তবে দাম বাড়ার দায় নিচ্ছে না কোনোপক্ষই। তেল, চিনিসহ ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতার জন্য খুচরা দোকানদার, পাইকার ও উৎপাদক কোম্পানির প্রতিনিধিরা একে অপরকে দোষারোপ করেছেন।