নিজস্ব প্রতিবেদক
ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেড (বিআইএফসি) থেকে এক যুগ আগে ঋণ হিসেবে নেয়া সাড়ে ৩৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থার উপপরিচালক মো. আব্দুল মাজেদ বাদী হয়ে বুধবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ মামলাটি করেন। এতে আসামি করা হয়েছে বিআইএফসির সাবেক চেয়ারম্যান ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান ও তার স্ত্রীসহ ১৩ জনকে। একইভাবে বিআইএফসি থেকে প্রায় ১২২ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে আরো কয়েকটি মামলা করেছে দুদক। প্রতিটিতেই এমএ মান্নানকে আসামি করা হয়েছে।
নতুন করা মামলায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর মান্নানের স্ত্রী এবং বিআইএফসির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান উম্মে কুলসুম মান্নানকেও আসামি করা হয়েছে। এছাড়া আসামি করা হয়েছে ঋণ নেয়া প্রতিষ্ঠান মেসার্স আব্দুল্লাহ ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. আমিনুর রহমান খান, বিআইএফসির পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, এএনএম জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক পরিচালক রইস উদ্দিন আহমেদ, সাবেক পরিচালক মহিউদ্দীন আহমেদ, সাবেক পরিচালক রোকেয়া ফেরদৌস, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহমুদ মালিক, সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ইনামুর রহমান, সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ ফকরে ফয়সাল ও সাবেক সিনিয়র অফিসার মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনকে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা একে অন্যের সহায়তায় প্রতারণামূলকভাবে চট্টগ্রামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মেসার্স আব্দুল্লাহ ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী আমিনুর রহমান খানের নামে ১৭ কোটি ৫০ হাজার টাকার ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ দেখিয়ে সুদসহ ৩৭ কোটি ৫৭ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬৭ টাকা আত্মসাৎ করেন। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬/৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
অনুসন্ধানকালে সংগৃহীত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা, অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য পর্যালোচনা ও ঘটনা উদ্ঘাটনে সহায়ক অন্য ব্যক্তিদের বক্তব্যও পর্যালোচনা করা হয় বলে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান মেসার্স আব্দুল্লাহ ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. আমিনুর রহমান খান জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য এক বছর মেয়াদে সাড়ে ১৭ কোটি টাকার ঋণ চেয়ে ২০১১ সালের ১৭ জুলাই বিআইএফসিতে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ মালিক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ইনামুর রহমান, এসডিপি ও হেড অব বিজনেস সৈয়দ ফকরে ফয়সাল, এসপিও ও ইউনিট হেড মো. আওলাদ হোসেন এবং সিনিয়র অফিসার ও রিলেশনশিপ ম্যানেজার মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন পরিচালনা পর্ষদের বিবেচনার জন্য একটি মেমো তৈরি করেন। মেমোটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯ শতাংশ সুদে ১২ মাসের জন্য এ ঋণের প্রস্তাব করা হয়। জামানত হিসেবে তারিখবিহীন স্বাক্ষরিত ২১ কোটি ১৩ লাখ ৩ হাজার ৯২৫ টাকার একটি চেক রাখার কথা বলা হয়। ওই বছরের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের ১০২তম সভায় এ ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়। ওই পর্ষদ সভায় উপস্থিত ছিলেন বিআইএফসির তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান, বিকল্প পরিচালক উম্মে কুলসুম মান্নান, পরিচালক আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, এএনএম জাহাঙ্গীর আলম, মহিউদ্দিন আহমেদ, রোকেয়া ফেরদৌস, রইস উদ্দিন আহমেদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ মালিক। যদিও অনুসন্ধানকালে জানা যায়, কোনো জামানত ছাড়াই আমিনুর রহমানের অনুকূলে এ ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ করা হয়েছে।
এর আগে বিআইএফসি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেখিয়ে শতকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব এমএ মান্নানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আরো ছয়টি মামলা করেছে দুদক। এর মধ্যে দুই মামলায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। মোট সাত মামলায় বিআইএফসি থেকে ঋণের নামে নেয়া প্রায় ১৫৮ কোটি ১ লাখ ৯৫ হাজার ১০৮ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মেজর (অব.) আবদুল মান্নান প্রতিষ্ঠিত সানম্যান গ্রুপ অব কোম্পানিজ এক সময় পরিচিতি পেয়েছিল শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে। দেশের তৈরি পোশাক খাতের শুরুর দিকের অন্যতম উদ্যোক্তা আবদুল মান্নানের ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়েছিল ওষুধ, এভিয়েশন, ফিশিং, শিপিং, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা, কোমল পানীয়, সিএনজি, রিয়েল এস্টেট ও টেলিযোগাযোগ খাতে। কম্বোডিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায়িক কার্যালয়ও খুলেছিলেন তিনি। সানম্যান গ্রুপের অধীন কোম্পানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় অর্ধশতে। যদিও বর্তমানে গ্রুপটির বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই এখন বেশ দুরবস্থায় রয়েছে। বড় ঋণখেলাপির তালিকায় নাম লিখিয়েছে গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠান বাংলালায়ন কমিউনিকেশন, বিআইএফসি ও গোল্ডেন হরাইজন লিমিটেড।
বিশেষ করে বিআইএফসির আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে আলোচনা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০১৫ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির ঋণ প্রদানে অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেই উঠে আসে। ওই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, বিআইএফসি থেকে অনিয়ম ও জালজালিয়াতির মাধ্যমে সানম্যান গ্রুপের অনুকূলে ৫১৮ কোটি টাকার ঋণ দেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব ঋণের সুবিধাভোগী সানম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বিআইএফসির সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আবদুল মান্নান।