ভুয়া ফেসবুক আইডি’র ফাঁদ হয়রানির শিকার ২৪৯৫৮ নারী

ভুয়া ফেসবুক আইডি’র ফাঁদ হয়রানির শিকার ২৪৯৫৮ নারী

স্বামী সংসার নিয়ে আনন্দে দিন কাটতো বীথির। হঠাৎ একদিন অপরিচিত ফেসবুক আইডি থেকে বার্তা আসে। তাকে দেয়া হয় কুপ্রস্তাব। অশ্লীল বার্তায় ভয় ও আতঙ্ক ভর করে তার। মেসেজের উত্তর দেয়া বন্ধ করেন। কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাবে রাজি না হলে ওই আইডি থেকে তাকে দেয়া হয় হুমকি। তার সন্তানকে অপহরণ করার ভয় দেখানো হয়। হুমকি পেয়ে বীথির পরিবার ভয় পেয়ে যান। ভয়ভীতি ও হুমকি থেকে বাঁচতে মামলা করেন। অভিযোগ তদন্ত করে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সার্ভিস।

 

শনাক্ত করা হয় অভিযুক্ত ওই ব্যক্তিকে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এভাবে ফাঁদে পড়ে বহু নারী-পুরুষ এমন যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। অনলাইনে এমন নিগৃহের ঘটনা ব্যাধির মতো সংক্রমিত হচ্ছে। পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ভুয়া ফেসবুক আইডি ব্যবহার, ফেসবুকে ঘনিষ্ঠতা, অন্তরঙ্গ ছবি শেয়ারিংয়ে বাড়ছে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি, আপত্তিকর ভিডিও পাঠানো হচ্ছে। আজেবাজে মেসেজ পাঠানো বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি আপলোড করা হলে পরে সেগুলোকে সফটওয়্যারের মাধ্যমে অশ্লীল ছবিতে রুপান্তর করে হয়রানির শিকার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ভুক্তভোগী নারীরা এসব বিষয়ে প্রায়ই অভিযোগ করছেন। অভিযোগের সূত্রধরে তারা এ ধরনের প্রতারকদের আইনের আওতায় আনছেন।

সূত্রমতে, ২০২০ সালের ১৬ই নভেম্বর সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের জন্য পুলিশ সাইবার সার্পোট ফর উইমেন সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়। সম্পূর্ণ নারী পুলিশ দিয়ে পরিচালিত এ সার্ভিসে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৪ হাজার ৯৫৮ জন ভুক্তভোগী নারী হয়রানির অভিযোগ করেছেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে শতকরা ১১ ভাগ নারীর বয়স ১৮ বছরের কম। অভিযোগকারীদের মধ্যে শতকরা ১১ ভাগ ১৮ বছরের কম বয়সী। শতকরা ৬০ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। ২৫-৩৫ এর মধ্যে ভুক্তভোগী ২৫ ভাগ এবং ৪ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৩৫ বছরের বেশি।

সূত্র জানায়, ভুক্তভোগী নারীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সাইবার অপরাধকে প্রথমে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। কিন্তু ২ বছরে অপরাধের ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। ভুক্তভোগীর ছবি, মোবাইল নম্বর, বাসার ঠিকানা, এনআইডি বা যেকোনো পরিচিত তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (প্রকৃত বা এডিট করে) পোস্ট, কমেন্ট ও কাউকে মেসেজের মাধ্যমে প্রকাশ করে হয়রানির অভিযোগের মধ্যে (ডক্সিং) ৮৩১, ইমপার্সোনেশন ৩৯৮, ব্ল্যাকমেইলিং ৫১৩, আপত্তিকর কন্টেন্ট ছড়ানো ১১০, সাইবার বুলিং ২১৭, আইডি হ্যাক ৪৩৮, মোবাইল হ্যারাসমেন্ট ১২১ ও অন্যান্য অভিযোগ ২৬ জন। এর আগে ২০২২ সালের ১৫ই নভেম্বর পর্যন্ত অভিযোগ করেন, ফেইক আইডি ৯ হাজার ৭১৪ জন, আইডি হ্যাক ২ হাজার ৭৮২, ব্ল্যাকমেইলিং ৩ হাজার ৭৬২, মোবাইল হ্যারাসমেন্ট ২ হাজার ২৮২, আপত্তিকর কন্টেন্ট ছড়ানো ২০০২, অন্যান্য ১ হাজার ৭৬২, মোট ২২ হাজার ৩০৪ জন।

গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ সাইবার সার্পোট ফর উইমেন এর ফেসবুক পেজে মোট ৩২০১৫টি মেসেজ, হটলাইন নম্বরে ৬০৯৮৫টি ফোনকল ও ই-মেইলে ৬৯০টি মেইল এসেছে। তালিকাভুক্ত সেবাপ্রত্যাশীর সংখ্যা ৩২০১৫ জন। সেবাপ্রত্যাশীদের মধ্যে ২৪ হাজার ৯৫৮ জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানি সংক্রান্তে যোগাযোগ করেছেন। যার মধ্যে ৮ হাজার ৩০১ জন পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রদান ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে অনাগ্রহ দেখিয়েছেন। মোট ১৫ হাজার ৯৮৩ জনের অভিযোগের বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া নিয়েছে। ৬৭৪ জনের অভিযোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, প্রতারক চক্ররা অল্প দিনে সম্পর্ক তৈরি করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। সাইবার স্পেসে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি প্রতারণার শিকার হচ্ছে। ফেইক আইডি বা অনলাইনে এই ধরনের ছবি প্রকাশ হলে সমাজের চোখে একজন পুরুষের চেয়ে নারীকে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়।
পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সার্ভিসের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খালেদা বেগম বলেন, অনেক কিশোর-কিশোরী এই ঘটনার ভুক্তভোগী হয়। ভুক্তভোগী নারীরা অনেক সময় এমনকি তাদের পরিবারকেও জানাতে চান না। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশা ও অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থানের নারীরা যোগাযোগ করছেন। অনেকেই চমৎকারভাবে নিজের সমস্যা জানাচ্ছেন। অনেক সময় সাধারণ পরামর্শ নিয়ে নিজেই নিজের সমস্যা সামাধান করে ফেলছেন। আবার সেই একই সমস্যা অনেকে সহজে সমাধান করতে পারছেন না। তাদের সাইবার ইউনিটের কর্মকর্তারা ধৈর্যের সঙ্গে সমস্যাটির সমাধানে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছেন। যথেষ্ট তথ্যাদির অভাবে কারও ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে কিছুটা সময় লাগছে। এ ছাড়া যে সব ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ইউমেন সে সব আইনি পদক্ষেপের ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ  বলেন, আমাদের কাছে প্রায় প্রতি মাসেই এ ধরনের অপরাধের অভিযোগ আসে। শত শত ভুয়া ফেসবুক আইডি ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা বিভিন্ন ভাবে প্রতারণা করে যাচ্ছে। ফেসবুকে একটি গাইড লাইন আছে। ৯০ শতাংশ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার সম্পর্কে এখনো ভালো জানে না। আমি যেটি ব্যবহার করবো সেটি যেন নিয়মের মধ্যে থাকে। সাইবার অপরাধীরা তাহলে সহজে আক্রমণ করতে পারবে না। এবং আমি নিজেও এই ধরনের অপরাধের শিকার হবো না। ফেসবুক ব্যবহারে সচেতন থাকতে হবে। অপরিচিত আইডিতে ভিডিও কলে কথা বলা আরও বড় এলার্মি বিষয়। আমি যদি কোনো প্রেম ঘটিত বিষয়, ফিন্যালসিয়াল ঝামেলার কারণে অপর প্রান্তের লোক এগুলো রেকর্ড করে রেখে পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে ব্ল্যাকমেইল করে। এটি বর্তমান সময়ে খুবই ভয়ঙ্কর।

 

তথ্য প্রুযুক্তি