ছয় মাসে বাজেটের মাত্র ২৪% বাস্তবায়ন

ছয় মাসে বাজেটের মাত্র ২৪% বাস্তবায়ন

চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাকালে দেশের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনা হবে জানিয়ে সে সময় তিনি ইউক্রেন সংকটজনিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করে চলতি অর্থবছরে অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। অর্থ জোগাড়ের নিশ্চয়তা না থাকলেও ওই সময়ে বাজেট ঘোষণা হয় ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার। অর্থবছরের প্রথম অর্ধাংশে (জুলাই-ডিসেম্বর) এ বাজেটের এক-চতুর্থাংশও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি সর্বশেষ মাসিক রাজস্ব প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মন্ত্রণালয় ও সরকারি বিভাগগুলো অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে বরাদ্দকৃত বাজেটের মাত্র ২৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দের মাত্র ১৪ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। আর পরিচালন খাতে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থ। যদিও সরকারের সংস্থাগুলো দাবি করছে, অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বাজেট অনেক গতি পাবে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের পর্যবেক্ষণ হলো সরকার এখন অর্থ সংগ্রহ নিয়ে বেশ চাপে রয়েছে। বিষয়টি এখন রীতিমতো বড় ধরনের সংকটে রূপ নিয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঘাটতি বাজেট পূরণে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে লক্ষ্যমাফিক অর্থ সংগ্রহ করা যায়নি। বিদেশী উৎস থেকে চলতি অর্থবছরে ঋণ নেয়ার নিট লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে নেয়া নিট বিদেশী ঋণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকায়। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাংক খাত থেকে নিট ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ব্যাংক খাত থেকে ২৪ হাজার ৭১৭ কোটি টাকার নিট ঋণ নেয়া হয়েছে। ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকেও এ সময়ে সরকারের নিট ঋণ বাড়েনি।

দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের অর্থ সংগ্রহ তেমন একটা না বাড়লেও সুদ বাবদ ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের চেয়েও অনেক বেশি। সরকারের পরিচালন ব্যয়ের ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ সুদ খাতে ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ হলেও ছয় মাসে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ অর্থ।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয়ের ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয় প্রশাসনিক খাতে। প্রথম ছয় মাসে এ খাতে সরকারের ব্যয় অনেক কমে এসেছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রশাসনিক খাতে প্রকৃত ব্যয় নেমে এসেছে ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশে। প্রশাসনিক ব্যয়ের মতোই নিয়ন্ত্রিত ছিল সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামো খাতের ব্যয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থবছরের শুরুতে বিশাল অংকের বাজেট ঘোষণা করলেও মূল্যস্ফীতির উচ্চহার আর ডলারসহ অর্থনৈতিক সংকট সরকারকে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণে বাধ্য করেছে। উন্নয়ন প্রকল্পে কাটছাঁটসহ সরকারের দৈনন্দিন ব্যয়ও কমিয়ে আনা হয়েছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকারের অর্থ সংকটও বেড়েছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঠিকাদারদের বিপুল অংকের বিল বকেয়া পড়েছে। বকেয়া পড়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে কেনা বিদ্যুতের ছয়-সাত মাসের বিলও। সঞ্চয়পত্রসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়ার খাতগুলোও সংকুচিত হয়ে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে অর্থের সংস্থানে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ বাড়াতে পারত সরকার। কিন্তু ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট সরকারের ঋণ নেয়ার ক্ষেত্র সংকীর্ণ করে দিয়েছে। পরিস্থিতির চাপে সরকারের জন্য ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন ক্রমেই দুরূহ হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চলতি অর্থবছরের বাজেট বহু আগেই ‘তামাদি’ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ এ ফেলো  বলেন, ‘এ বাজেট প্রণয়নের আগে আমরা একটি অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট দেয়ার দাবি জানিয়েছিলাম। পরিস্থিতির বিচারে আমরা বলেছিলাম, প্রথাগত বাজেট দিয়ে অর্থনৈতিক মন্দা ও সংকট এড়ানো সম্ভব হবে না। কিন্তু সে সময় আমাদের পরামর্শ আমলে নেয়া হয়নি। বিশাল অংকের একটি বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগই দৃশ্যমান নয়। ফলে এ বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন নিয়ে কথা অর্থহীন। চলতি অর্থবছরের বাজেট বহু আগেই তামাদি হয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি পরিচালনাকারীরাও বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে ভাবেন বলে মনে হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেটুকুু ভাবা হচ্ছে, সেটিও কেবল আইএমএফের ঋণ প্রাপ্তির শর্ত পূরণের জন্য। দুর্নীতি বন্ধ, রাজস্ব খাতের সংস্কার, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে সুশাসন না ফেরালে বাজেটকে জনকল্যাণমূলক করা যাবে না।’

২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটের মোট আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঘাটতি বাজেট ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ঘোষিত বাজেটে পরিচালন খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস তথা ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে পরিচালন খাতে মাত্র ১ লাখ ২৬ হাজার ২১২ কোটি টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে বাজেট বাস্তবায়নের হার ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থ সংকটের কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের কেনাকাটা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন ব্যয়ও কমিয়ে আনা হয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ঠিকাদারদের বিলও ঠিকমতো পরিশোধ করা হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সংকটের কারণে অর্থবছরের শুরু থেকেই উন্নয়ন প্রকল্পে কাটছাঁট করছে সরকার। ঘোষিত বাজেটে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এ খাতে ৩৬ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। উন্নয়ন খাতে বাজেট বাস্তবায়নের হার মাত্র ১৪ শতাংশ বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। পরিচালন ও উন্নয়ন খাত মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৬ লাখ ৭১ হাজার ২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার। যদিও ছয় মাসে মোট ১ লাখ ৬২ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়নের হার মাত্র ২৪ দশমিক ২৩ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার দেখেশুনে পথ চলছে বলে জানান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। দেশের বাজারেও নির্মাণসামগ্রীসহ সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যদি কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি না নিত, তাহলে দেশে মূল্যস্ফীতির হার আরো বেড়ে যেত। সরকার মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির ক্ষেত্রে সংযত ও সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছে।’

সংযত হতে গিয়ে সরকার বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো থেকে সরে আসছে কিনা জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন থেকে সরকার সরে যায়নি। জানুয়ারি পর্যন্ত গত বছরের তুলনায় উন্নয়ন বরাদ্দ ব্যয় ২ শতাংশ পিছিয়ে আছে। আশা করছি, অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। এক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও সেটি গত বছরের তুলনায় খুব বেশি কম হবে না। আমরা চেষ্টা করছি, সীমার মধ্যে থেকে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে যতটা কম ঋণ নেয়া যায়। কারণ ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত না হলে সেটি অর্থনীতির জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না। বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আশা করছি, অর্থবছরের শেষ নাগাদ আরো ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে সরকারের বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৯৪৯ কোটি বা ৬৯ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। আর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে বিদেশী উৎস থেকে ১ হাজার ২৩৮ কোটি ডলারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে বিদেশী ঋণ এসেছে ৪২৬ কোটি ডলার। এ সাত মাসে সুদসহ ১২৮ কোটি ডলারের বিদেশী ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি ৭ লাখ ১৬ হাজার ১৫৭ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি ২ লাখ ৮০ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। বাকি ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকার ঋণ এসেছে সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য উৎস থেকে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৬ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। সে হিসেবে গত এক বছরে সরকারের ঋণ স্থিতি ১ লাখ ৯ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা বেড়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারকে ৫১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা ঋণের জোগান দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারকে জোগান দেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান জানান, ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণের জোগানের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সেটি তফসিলি ব্যাংকের কাছ থেকে হোক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে হোক। বাংলাদেশ ব্যাংক গত এক বছরে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এর মাধ্যমে সমপরিমাণ টাকা বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে এসেছে। দেশের ব্যাংক খাতে তারল্যের ওপর চাপ তৈরি হওয়ার এটিও অন্যতম কারণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান দিয়েছে। তবে সরকারের দিক থেকে চাহিদা কম থাকায় বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণের প্রয়োজন হয়নি।

অর্থ বাণিজ্য