ডলার সংকটে এলসি খোলা ব্যাহত বাকিতে দুই লাখ কোটি টাকার পণ্য আমদানি

ডলার সংকটে এলসি খোলা ব্যাহত বাকিতে দুই লাখ কোটি টাকার পণ্য আমদানি

বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে দেশীয় উদ্যোক্তাদের বাকিতে বা ঋণ করে পণ্য আমদানির প্রবণতা বেড়েছে। একই সঙ্গে বিদেশি ব্যবসায়ীদের বাজার ধরে রাখতে এবং উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে রপ্তানি করছেন বাকিতে বা ঋণ দিয়ে।

মন্দায় আমদানিকারক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে চাহিদা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে দেড় বছর ধরে বাকিতে পণ্য আমদানির প্রবণতা বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতে বকেয়া অর্থের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯৫৭ কোটি ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। গত এক বছরে এর মাধ্যমে ১ হাজার ৯৭৬ কোটি ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়েছে।

এসব ঋণ ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে পরিশোধের কথা থাকলেও মন্দায় সক্ষমতা কমায় তা পরিশোধের মেয়াদ ১ থেকে ২ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর বিপরীতে ৬ থেকে ৮ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। ফলে আমদানির খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে পণ্যের দাম বেড়ে এর দায় এসে পড়ছে সরাসরি ভোক্তার ওপর।

সূত্র জানায়, বাকিতে পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে অর্থায়ন বা ঋণ সুবিধা চালু রয়েছে। যার নাম বায়ার্স ক্রেডিট বা ক্রেতার ঋণ। বাকিতে পণ্য আমদানি করতে উদ্যোক্তারা এসব ঋণ দেওয়া-নেওয়া করেন। এই ঋণ নিতে হলে রপ্তানিকারকের কাছে আমদানিকারককে বিশ্বস্ত হতে হয়।

আমদানিকারকের ব্যক্তিগত, করপোরেট সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের গ্যারান্টি দিতে হয়। এর বিপরীতে আমদানিকারক রপ্তানিকারকের কাছ থেকে বাকিতে পণ্য আনতে পারেন। মেয়াদ শেষে সুদসহ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। ঋণের মেয়াদ থাকে সাধারণত ৩ থেকে ৪ মাস। বৈশ্বিক মন্দার কারণে উদ্যোক্তাদের এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুযায়ী ডলারের জোগান দেওয়ার সক্ষমতা না থাকায় এসব ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।

বেশ কয়েক দফায় বায়ার্স ক্রেডিট পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। করোনার সংক্রমণ শুরু হলে ২০২০ সালের জুন থেকে এর মেয়াদ বাড়ানো শুরু হয়। এর আগে এসব ঋণ পরিশোধের মেয়াদ সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাড়ানো হতো না। তবে আমদানিকারক, রপ্তানিকারক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সম্মতিতে বাড়ানো যেত। বাকিতে পণ্য আমদানি করে পরে দেনা শোধ করা হয় বলে এ প্রক্রিয়াকে বাকিতে পণ্য আমদানি হিসাবেও অভিহিত করা হয়।

করোনার আগে এসব ঋণে পণ্য আমদানি খুব বেশি হতো না। কারণ, এতে সুদের হার বেশি। ফলে খরচও বেশি পড়ে। ২০২০ সালের আগে মোট আমদানির ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হতো বায়ার্স ক্রেডিটে। করোনার সময়ে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের প্রথমদিক পর্যন্ত ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে আমদানিও কমেছে। করোনার সংক্রমণ কমলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকে।

এতে চাহিদা বাড়ায় বেড়ে যায় পণ্যের দামও। এর সঙ্গে যোগ হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ। এতে প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হার পাগলা ঘোড়ার গতিতে বাড়তে থাকে। চড়া দামে পণ্য আমদানি করতে গিয়ে ডলার সংকটে পড়ে প্রায় সব দেশ। বেড়ে যায় ডলারের দাম। তখন চাহিদা অনুযায়ী ডলারের জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এ পরিস্থিতিতে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক বাকিতে পণ্য বেচাকেনা বাড়িয়ে দেন। এর প্রভাবে দেশে বায়ার্স ক্রেডিটের মাত্রাও বেড়ে যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালে জুনে বায়ার্স ক্রেডিটের স্থিতি ছিল ৫৭৭ কোটি ডলার। একই বছরের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮৮ কোটি ডলারে। ওই সময়ে ঋণ বেড়েছে ১০ কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ওই বছরের ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৮২১ কোটি ডলারে। ওই সময়ে বেড়েছে ২৩৩ কোটি ডলার বা ৩৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২১ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর সময়ে বায়ার্স ক্রেডিট বেড়েছে ২৪৪ কোটি ডলার বা ৪২ দশমিক ২৯ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় উদ্যোক্তাদের পক্ষে চাহিদা অনুযায়ী ডলারের জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। যে কারণে তারা বায়ার্স ক্রেডিটে পণ্য আমদানি বাড়াতে থাকেন।

২০২২ সালের মার্চে বায়ার্স ক্রেডিটের স্থিতি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬৫ কোটি ডলারে। আগের বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় বেড়েছিল ১৪৪ কোটি ডলার বা ১৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। একই বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৭৮ কোটি ডলারে। আগের ত্রৈমাসিকের তুলনায় বেড়েছিল ১৩ কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বায়ার্স ক্রেডিট আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৯ কোটি ডলারে। জুনের তুলনায় বেড়েছিল ৪১ কোটি ডলার বা ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। ওই বছরের শেষ প্রান্তিক ডিসেম্বরে ঋণের স্থিতি কমে দাঁড়ায় ৯৫৭ কোটি ডলারে। সেপ্টেম্বরের তুলনায় কমেছিল ৬২ কোটি ডলার বা ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে ডলারের হিসাবে ঋণ সামান্য কমলেও টাকার হিসাবে বেড়েছে। কারণ, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ২৬ শতাংশ। ফলে কম ডলার ঋণ নিয়েও বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। কারণ ডলারের ঋণ নিয়ে পণ্য আমদানির পর সেগুলো অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাকে টাকায় ব্যাংক ঋণের কিস্তি জমা দিতে হয়। ব্যাংক সে টাকা দিয়ে ডলার কিনে তা পরিশোধ করে।

২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাপকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি যেমন কমেছে, তেমনই ঋণও কিছুটা কমেছে।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ডিসেম্বর পর্যন্ত বায়ার্স ক্রেডিটের মোট স্থিতি ১ হাজার ৯৭৬ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা।

২০২১-২২ অর্থবছরে বায়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে বাকিতে পণ্য আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৩৩১ কোটি ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার। আগের বছরের তুলনায় ডলারের হিসাবে বৃদ্ধির হার ৪২ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং টাকার হিসাবে ৪৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ওই অর্থবছরে মোট আমদানি হয়েছিল ৭ হাজার ৫৭৭ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে বায়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে এসেছে মোট আমদানির ৩০ দশমিক ৭৬ শতাংশ পণ্য। আগের অর্থবছরের তুলনায় এর মাধ্যমে আমদানি বেড়েছে ৪৫ শতাংশ।

২০২০-২১ অর্থবছরে মোট আমদানি হয়েছিল ৫ হাজার ১০৬ ডলার। এর মধ্যে বায়ার্স ক্রেডিটে আমদানি হয়েছিল ১ হাজার ৬৩৩ কোটি ডলার, যা মোট আমদানির ৩১ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট আমদানি হয়েছিল ৪ হাজার ৫৬৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে বায়ার্স ক্রেডিটে হয়েছিল ১ হাজার ৪২৪ কোটি ডলার, যা মোট আমদানির ৩১ দশমিক ১৮ শতাংশ।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট আমদানি ছিল ৫ হাজার ২৩৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে বায়ার্স ক্রেডিটে আমদানি হয়েছিল ১ হাজার ৫১৬ কোটি ডলার, যা মোট আমদানির ২৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট আমদানি হয়েছিল ৪ হাজার ৯৩৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে বায়ার্স ক্রেডিটে আমদানি হয়েছিল ৯০০ কোটি ডলার। মোট আমদানির ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ।

সূত্র জানায়, আগে বায়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করা হতো। এখন এসব পণ্যের পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যও আমদানি হচ্ছে। যে কারণে বায়ার্স ক্রেডিটের ওপর চাপ বেড়েছে।

অর্থ বাণিজ্য