এবার রোজায় ইফতারির তালিকা থেকে কাটছাঁট হবে ফল

এবার রোজায় ইফতারির তালিকা থেকে কাটছাঁট হবে ফল

‘এখনই যে দাম! এবার রোজায় ইফতারিতে আর ফল খাওয়া লাগবে না। এক কেজি আপেল কিনতেই ৩০০ টাকা নাই।’ গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ফুটপাতের দোকান থেকে এ দামে আপেল কিনে হাপিত্যেশ হাসান সোহেলের।

গত শুক্রবার হাতিরপুল কাঁচাবাজারে অনেক দরকষাকষি করে ১৯০ টাকায় এক কেজি কমলা কেনেন গৃহিণী নুর নাহার বেগম। ভূতের গলি এলাকার এই ক্রেতা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘কোনো ফলেই হাত দেওয়া যাচ্ছে না। ছোট্ট একটা তরমুজের দামও চায় ৩০০ টাকা। এত দাম দিয়ে ফল কেনার তো কুদরত নাই।’

নুর নাহার বেগমের স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মোটামুটি ভালো বেতনের চাকুরে। বাসা ভাড়া, ছেলেমেয়ের খরচ, পরিবারের মাসের বাজারসহ সব ব্যয়ের পরও তাঁদের কিছু সঞ্চয় থাকে। তিনি বলেন, যে পরিমাণে দাম চায় তাতে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষরাই এক কেজির বেশি কেনার সাহস পাই না। অন্যদের অবস্থা তাহলে কী? হাসান সোহেল আর নুর নাহার বেগমের মতো অনেকেরই বাজারে ফল কিনতে গিয়ে এভাবেই মন ভাঙছে। বাজারে বিদেশি আপেল-কমলার দাম যেমন আকাশছোঁয়া, তেমনি বাড়বাড়ন্ত দেশে উৎপাদিত কলা, তরমুজ, আনারসসহ নানা দেশি ফলের দামও। দামের কারণে এবার ইফতারির ফর্দ থেকে অনেককেই ফল কাটছাঁট করতে হবে।

ডলার সংকটের কারণে গত ২৩ মে ফুল, ফল, প্রসাধনী ও আসবাবপণ্য আমদানিতে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সাধারণত আপেল, আঙুর, লেবুজাতীয় ফল, ডুমুর, আনারস, পেয়ারা, আম, বাদাম, অ্যাভোকাডোসহ নানা জাতের ফল আমদানি করা হয়। এসব ফলে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক গুনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের।

শুল্ক বাড়ানোর কারণে ফলের আমদানি খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ে অনেকেই এলসি বা ঋণপত্র খুলতে পারেনি। এ কারণে বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। যদিও দেশি ফলের দাম বাড়ার কোনো কারণ বলেননি ব্যবসায়ীরা।

বাজারে দেশি-বিদেশি সব ধরনের ফলের দাম চড়া। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি কেজি গালা আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ২৯০ টাকায়। এই ধরনের আপেলের কেজি মাসখানেক আগেও ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। কেজিতে ৬০ টাকা বেড়ে চায়না ফুজি আপেলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা। দুই মাস আগে সবুজ আপেলের দাম ছিল ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। এই ধরনের আপেলের কেজি কিনতে এখন ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ২৯০ থেকে ৩০০ টাকা। মাল্টার দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা। প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, যা আগে পাওয়া যেত ১৬০ থেকে ১৭০ টাকার মধ্যে।

কেজিতে ২০ থেকে ৫০ টাকা দাম বেড়েছে আনারের। আকারভেদে প্রতি কেজি আনারের দাম রাখা হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। এক-দেড় মাস আগেও আনার পাওয়া যেত ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়।

মাসখানেক আগে সাদা আঙুর বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকার আশপাশে। এখন কিনতে লাগছে ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা। কালো আঙুরের কেজি বিক্রি হয়েছিল ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায়। দাম বেড়ে হয়েছে এখন ২৯০ থেকে ৩০০ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে আঙুরের দাম বেড়েছে ৪০ টাকা। কেজিতে ৫০ টাকার মতো বেড়ে নাশপাতির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। এক-দেড় মাস আগে এ ফলের দাম ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। একসময় কমলা ডজন হিসেবে বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হয় কেজি দরে। প্রতি কেজি কমলার দাম রাখা হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা।

বিদেশি এসব ফলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রায় সব দেশি ফলের দামও বেড়েছে। মাঝারি আকারের এক ডজন বাংলা কলার দাম বিক্রেতারা চাইছেন ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এ ধরনের কলার ডজন সাধারণত ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত। চাপা কলার ডজন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ ও নেপালি জাতের কলার ডজন চলছে ৮০ থেকে ১২০ টাকা। হাইব্রিড জাতের বরই বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১৩০ টাকা দরে।

ড্রাগন ফল এখন দেশেও চাষ হয়। এ ফলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা। একইভাবে তরমুজও বিক্রি হচ্ছে কেজি দরে। প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা। সেই হিসাবে মোটামুটি মাঝারি আকারের একটা তরমুজের দাম পড়ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। মাঝারি আকারের আনারসের পিস বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা। বেলের দামও রোজার আগেই ছুটছে। বাজারে দুই-একটা দোকানে কাঁঠালের দেখা মিলছে। তবে দাম অস্বাভাবিক। বিক্রেতারা একটি ছোট আকারের কাঁঠালের দাম চাইছেন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। একটি ডাব কিনতে গেলে গুনতে হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।

দাম বাড়ার কারণে বিক্রি কমেছে বলে জানান খুচরা ব্যবসায়ীরা। কারওয়ান বাজারের ফল বিক্রেতা মো. বোরহান বলেন, ‘দাম বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষ কম কিনছে। আগে যিনি দুই-তিন কেজি করে আপেল-মাল্টা কিনতেন এখন এক কেজির বেশি কিনতে চান না। কেউ কেউ এমনভাবে মুলামুলি করেন বিরক্ত হয়ে যাই।’

ডলারের কারণে অন্তত ৩০ শতাংশ দাম এমনিতেই বেড়েছে বলে জানান ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল করিম। তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে দেশে ডলারের দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। ফলে যে কোনো পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের এই বাড়তি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। ফল আমদানিতেও অতিরিক্ত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ বেশি খরচ হচ্ছে। এই ব্যয় তো ফলের বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে যোগ হবে। স্বাভাবিকভাবেই ফলের দাম কিছুটা বাড়ার কথা। তবে সেই হারে দাম বাড়েনি।

বাদামতলীতে পাইকারি বাজারে ফলের দাম কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, সাদা আঙুর কেজি ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা বাজারে এরচেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এর জন্য পাইকাররা দায়ী নন।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি শামসুল হক বলেন, বিক্রি স্বাভাবিক আছে। এবার ডলারের কারণে আমদানি খরচ বেড়েছে। তবুও রোজায় ফলের দাম স্বাভাবিক থাকার কথা।

অর্থ বাণিজ্য