নিজস্ব প্রতিবেদক
হঠাৎ আলোচনায় আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে হৃদয়। এখন একটাই প্রশ্ন, কে এই আরাভ। আরাভ দাবি করছেন তিনি কানাডার নাগরিক। অথচ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ভারত হয়ে দুবাই কেন গেলেন? তিন বছরে কীভাবে এত ধনী হলেন? আলাদিনের চেরাগ তিনি কোথা থেকে পেলেন? তার এত রাজকোষ কোথা থেকে এলো? কীভাবে এত টাকা পেলেন? এত সব প্রশ্নের মধ্যেও কৌতূহল দেখা দিয়েছে যে, পুলিশ কর্মকর্তা খুনের পর কীভাবে তিনি ভারতে গেলেন। কানাডার নাগরিক হওয়ার পরও কেন ভারতীয় পাসপোর্ট নিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাও তার ছিল বলে দাবি করেছেন। এর পরও দুবাইয়ে কেন তিনি অবস্থান করছেন। এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, দুবাইয়ে স্বর্ণের ব্যবসা ছাড়াও বাংলাদেশে আরাভের আর কী কী ব্যবসা আছে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। প্রতারণা আর ব্ল্যাকমেলিং ছিল তার আয়ের অন্যতম উৎস। দুবাইয়ে তার স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ তারকাদের ছুটে যাওয়ার খবর এখন পুরনো। আরাভ যে পুলিশ কর্মকর্তা খুনের মামলার পলাতক আসামি, সামনে এসেছে তাও। যদিও দুবাইয়ে তার বিপুল অর্থের মালিক আসলে কে, তা নিয়েও রয়েছে রহস্য। চলছে নানা গুঞ্জন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানই কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামের রবিউল ইসলাম ওরফে হৃদয় ওরফে সোহাগ মোল্লা। তার উত্থানের গল্প বিস্ময়কর। ৩৫ বছর বয়সী আরাভ তিন ভাই-বোনের মধ্যে বড়। তার বাবা জীবিকার তাগিদে যুবক বয়সে কোটালীপাড়ায় এসেছিলেন। সেখানে সিলভারের হাঁড়ি-পাতিল কাঁধে বহন করে ফেরি করতেন। সংসারের অভাব দেখে ঢাকায় চলে আসেন আরাভ। এরপর উচ্চবিত্ত শ্রেণির নারীদের টার্গেট করতে থাকেন তিনি। বিয়ে করেন একাধিক। পাঁচ-সাতজন নারী এলাকায় তার স্ত্রী দাবি করেছিলেন। এ নিয়ে নানা সময়ে সালিশও হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রায় ১০ বছর আগে আরাভ নিজের টাকায় গ্রামে একটি পাকা দেয়ালের টিনশেড বাড়ি করেন। সেখানে আরাভের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তার বাবা-মা বসবাস করতেন। গ্রামের বাড়ি গেলে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করতেন। দুবাইয়ে তার স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের আগেই একমাত্র ছেলে, বাবা-মা ও দুই বোনকে সেখানে নিয়ে যান। বর্তমানে তাদের গ্রামের বাড়ি ফাঁকা। কোটালীপাড়ার হিরণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাজহারুল আলম পান্না বলেন, ‘আরাভ খানকে আমরা এলাকায় সোহাগ নামে চিনতাম। এরপর সে তার নাম রাখে আপন খান। এখন শুনি তার নাম রবিউলও। ১৯৮৮ সালে তার জন্ম। সে বড় হয়েছে চিতলমারির মোল্লার হাটে নানার বাড়িতে। তার একাধিক বিয়ের তথ্য আমরা জেনেছি। স্থানীয়ভাবে একটি বিয়ের অভিযোগ আমি মীমাংসা করে দিই। মুন্সীগঞ্জে এক মহিলা মেম্বারকেও বিয়ে করেছিল বলে শুনেছিলাম। ঢাকায় কেয়া নামে একজনকে বিয়ে করেছিল। ওই মেয়ে গ্রামে এসে কিছুদিন ছিল। সম্প্রতি ওমরাহ? হজ করতে গেলে সৌদির রিয়াদে আমাদের এলাকার অনেকে থাকে, সেখানে আরাভের বংশেরও ৪০-৫০ জন লোক থাকে, রিয়াদে আমাদের এলাকার লোকজন আমাকে সংবর্ধনা দিতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, ওই অনুষ্ঠানে আরাভও এসেছিল।’
তিনি বলেন, ‘ওমরাহ থেকে আসার পর আমি ঢাকায় অবস্থান করছিলাম। দুবাইয়ে তার স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের আগে শুনি তার বাবা-মা, বোনেরা দুবাইয়ে যাবেন, ভিসা পেয়েছেন। শুনে আমি অবাক হই। কারণ তাদের সংসার চালাতে অনেক টানাটানি। পাঁচ-সাত বছর আগে গ্রামে বাবার নামে দুই বিঘা জমি কেনে আরাভ। গত বছর সেখান থেকে এক বিঘা বিক্রি করে টাকাও নিয়েছে সে। তবে গ্রামে সে তেমন আসত না। হঠাৎ তার দুবাইয়ে স্বর্ণের ব্যবসা আর এত টাকা-পয়সার খবর শুনে আমি নিজেও অবাক। বিশ্বাসই হয় না। তবে এর নেপথ্যে অন্য কেউ আছেন। কেউ হয়তো তাকে ব্যবহার করে দুবাইয়ে ব্যবসা করছেন। আমার কাছে এটি রহস্যজনক মনে হচ্ছে। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় আরাভ এলাকায় এসেছিল। এক দিনের বেশি থাকেনি। এরপর আর সে বাড়ি আসেনি।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আরাভের বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য এখনো আমাদের কাছে নেই। তবে পেলে শিগগিরই জানানো হবে।’ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন এমরান খানকে ২০১৮ সালের ৮ জুলাই হত্যা করা হয়। এরপর লাশ পুড়িয়ে গুমের চেষ্টা করা হয়। সেই হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে আরাভ খান।
এনআইডিতে আরাভ খানের নাম রবিউল ইসলাম : দুবাইয়ে সোনার দোকান চালু করে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত আরাভ খানের জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম রবিউল ইসলাম। তার বাংলাদেশি পরিচয়পত্র থাকলেও সংযুক্ত আরব আমিরাতে তিনি ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে গেছেন। নির্বাচন কমিশন সূত্রে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ইসি সূত্রে জানা গেছে, আরাভ খানের এনআইডিতে নাম হচ্ছে রবিউল ইসলাম। এনআইডিতে তার পিতার নাম মতিউর রহমান, মায়ের নাম লাখি এবং রুমা নামে স্ত্রীর নাম উল্লেখ আছে। এনআইডির তথ্য অনুযায়ী, তিনি মাধ্যমিক পাস এবং জন্মস্থান বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার কোদালিয়া ইউনিয়নে।
ঢাকায় পুলিশ পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ। গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও গত বছরের মার্চ এবং সবশেষ ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ফেসবুক লাইভে তিনি তার উপস্থিতির জানান দিয়েছিলেন।