ঘুমচোখে গাড়ি চালানোর পরিণতি, ৩০ ঘণ্টার বেশি বাস চালিয়ে ক্লান্ত ছিলেন চালক

ঘুমচোখে গাড়ি চালানোর পরিণতি, ৩০ ঘণ্টার বেশি বাস চালিয়ে ক্লান্ত ছিলেন চালক

সাত মাস আগে ইমাদ পরিবহনে চালক হিসেবে যোগ দেন জাহিদ হাসান (৪০)। ওই পরিবহনের বাসগুলো খুলনা, পিরোজপুর ও সাতক্ষীরা থেকে রাজধানী ঢাকায় চলাচল করে। পরিবহন কোম্পানিটির চালকদের বাস চালাতে হয় অনেকটা বিরামহীনভাবে। জাহিদ হাসানকেও বাস চালাতে হতো ক্লান্ত দেহে, চোখে ঘুম নিয়ে। বিশ্রামের ফুরসত পেতেন না বললেই চলে। আর পরিণতিই যেন দেখা গেল গতকাল রোববার সকালে।

চালক জাহিদ হাসান ইমাদ পরিবহনের বাসটি নিয়ে গতকাল ভোরে খুলনা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে তাঁর বাসটি। এতে তিনিসহ ১৯ যাত্রী নিহত হন। ক্লান্ত দেহে ঘুমচোখে অতিরিক্ত গতিতে বাস চালানোর কারণে এত প্রাণহানি হয়েছে বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। জাহিদ হাসানের ছেলেও জানিয়েছেন, টানা বাস চালিয়ে তাঁর বাবা ক্লান্ত ছিলেন।

 

 

দুর্ঘটনায় নিহত ১৯ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সর্বশেষ চালকের সহকারী ইউসুফের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশ আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি করেছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র জানিয়েছে, বাসটির চলাচলের অনুমতি ছিল না। ফিটনেস সনদের মেয়াদও পেরিয়ে গিয়েছিল।

হাইওয়ে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গতকাল ভোর চারটার দিকে খুলনার ফুলতলা থেকে ইমাদ পরিবহনের বাসটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ভোর ৫টা ৫ মিনিটে খুলনার সোনাডাঙ্গা থেকে বাসটি যাত্রী নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়। বাসটির চালক সকাল সাড়ে সাতটার দিকে পদ্মা সেতুতে ওঠার আগে এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারান। এতে বাসটি এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে ছিটকে পড়ে। এরপর কমপক্ষে ১০০ ফুট নিচে এক্সপ্রেসওয়ের আন্ডারপাসের দেয়ালের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লেগে বাসটি দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই চালক জাহিদ হাসান, তাঁর সহকারী ইউসুফসহ ১৭ জনের মৃত্যু হয়। চিকিৎসার জন্য ১২ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে বাসটির সুপারভাইজার মিনহাজসহ আরও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়।

ক্লান্ত শরীরে ঘুমচোখে ছিলেন চালক

ইমাদ পরিবহনের চালক জাহিদ হাসান বৃহস্পতিবার ঢাকার দোলাইরপাড়ের বাসা থেকে বের হন। ওই দিন রাতেই যাত্রীবাহী বাসটি নিয়ে যান পিরোজপুরে। পরের দিন শুক্রবার সকালে পিরোজপুর থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসেন। শুক্রবার বিকেলে আবার যাত্রী নিয়ে ছুটে যান পিরোজপুরে। রাতে পিরোজপুর পৌঁছে পরের দিন শনিবার সকালে আবার যাত্রী নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসেন। ঢাকা থেকে শনিবার দুপুরে আবার ছুটে যান খুলনায়। রাতে বাসের মধ্যে তিন থেকে চার ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে রোববার ভোর চারটায় খুলনার ফুলতলা থেকে বাসটি নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এভাবে তিনি গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় বাস চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

গতকাল বিকেলে জাহিদের ছেলে রাতুল হাসান বাবার লাশ শনাক্ত করার জন্য শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবা সপ্তাহে এক দিন বাসায় আসার সুযোগ পান। গাড়ি চালিয়ে তিনি সব সময় ক্লান্ত থাকেন। বৃহস্পতিবার বাসা থেকে বের হয়ে ঢাকা, পিরোজপুর, খুলনা রুটে পাঁচটি ট্রিপে বাস চালিয়েছেন। বাবা শনিবার রাতে ফোনে জানান, তিনি খুব ক্লান্ত ছিলেন। রোববার ঢাকায় ফিরে বাসায় এক দিন বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাবা আমাদের ফাঁকি দিয়ে চির বিশ্রামে চলে গেলেন।’

চালকদের ব্যস্ত সূচি ও বিশ্রামের ঘাটতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইমাদ পরিবহনের ব্যবস্থাপক (অপারেশন) ওয়াহিদুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির বাস যাঁরা চালান, তাঁদের বিশ্রামের জন্য প্রতিটি জায়গায় আমাদের ঘর রাখা আছে। দুর্ঘটনাকবলিত বাসটির চালক জাহিদ ক্লান্ত ছিলেন, তিনি এমন কথা আমাদের কাউকে জানাননি।’

চালকের ক্লান্তির কথা বলেছেন শিবচর হাইওয়ে পুলিশের ওসি আবু নাঈম মো. মোফাজ্জেল হকও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে জেনেছি, ইমাদ পরিবহনের বাসটির চালক কোনো রকম বিশ্রাম না নিয়ে বাসটি চালাচ্ছিলেন। দীর্ঘ সময় বাস চালানোর কারণে তিনি ক্লান্ত ছিলেন। সকাল সকাল ঘুম ঘুম চোখে বাস চালানোয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন তিনি।’

অতি গতির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারায় বাস

ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে এক্সপ্রেসওয়ের শুরু। পদ্মা সেতুসহ ৭৫ কিলোমিটারের সড়কটি শেষ হয়েছে ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। এরপর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় আলাদা সড়ক ধরে যানবাহনগুলো চলাচল করে। সরকার এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির গতি নির্ধারণ করেছে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। কিন্তু ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালান চালকেরা। এর আগে গত ১৭ জানুয়ারি অতি গতিতে চলতে গিয়ে রোগীবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্স ট্রাকের পেছনে ঢুকে যায়। এতে ছয়জন নিহত হন। ঘটনাটি ঘটে সড়কটির জাজিরার নাওডোবা এলাকায়।

গতকাল ইমাদ পরিবহনের বাসটি চলছিল অতিরিক্ত গতিতে। বাসের যাত্রী ছিলেন খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামুদার ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সাইফুল ইসলাম। তিনি বাসের পেছনের অংশে বসে ছিলেন। আহত হয়ে তিনি চিকিৎসা নেন শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুলনার সোনাডাঙ্গা থেকে বাসটি ছাড়ার পর হাইওয়েতে উঠেই বেপরোয়া গতিতে বাসটি চালানো হচ্ছিল। আমরা যাত্রীরা কয়েক দফা বারণ করেছিলাম। কিন্তু চালক কারও কোনো কথা শোনে নাই। বাসটির ব্রেক চাকার সঙ্গে ভালোমতো কাজ করছিল না। এমন কথা চালক ও হেলপার নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করছিল।’

উদ্ধার করা মরদেহগুলোর সুরতহাল করেছেন শিবচর হাইওয়ে থানার উপপরিদর্শক আবদুল্লাহেল বাকী। তিনি বলেন, বাসের প্রথম অংশের যাত্রীরা মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।

এক জেলার ৮ জনের প্রাণহানি

দুর্ঘটনায় নিহত ১৯ জনের মধ্যে ৮ জনের বাড়ি গোপালগঞ্জে। বাকি ১১ জনের মধ্যে খুলনার ৪ জন, বাগেরহাটের ২ জন, ফরিদপুর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পাবনার ১ জন করে।

গোপালগঞ্জের বনগ্রাম এলাকার শামসুল হকের ছেলে মোস্তাক আহমেদ (৪২) তিন বছর আগে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আবারও তিনি সিঙ্গাপুরে যেতে ভিসার জন্য ঢাকায় যাচ্ছিলেন। এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান মোস্তাক।

মোস্তাকের স্ত্রী জোনাকি বেগম  বলেন, ‘আমার সব শ্যাষ হইয়া গেল। আমার ছোট ছোট দুই পোলা লইয়া কই যামু আমি। স্বামী ছাড়া আমাগো দেখার কেউ নাই। আল্লাহ তুমি আমারে মরণ দিতা। আমার স্বামীকে ফিরাইয়া দাও তুমি।’

ফরিদপুর জোনের হাইওয়ে পুলিশ সুপার মাহাবুবুল হাসানবলেন, ‘বাসটির ফিটনেসে ও যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে। আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। তদন্ত শেষেই বাসটির মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি জানান, এক্সপ্রেসওয়েতে যেন অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চলতে না পারে, সে জন্য তাঁদের টিম কাজ করছে। অতিরিক্ত গতিতে কোনো গাড়ি চললেই মামলা দিয়ে থাকেন তাঁরা।

চার জেলায় নিহত ৫

দেশের চার জেলা—পিরোজপুর, বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা ও কুড়িগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই মোটরসাইকেল আরোহীসহ অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুর্ঘটনাগুলো ঘটে।

সারাদেশ