টানা এক বছর কমার পর ২০২২ সালের শেষ তিন মাসে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে (এনবিএফআই) সার্বিক আমানত পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে আমানত বৃদ্ধির এই স্বস্তির খবরের মধ্যেও বড় দুঃসংবাদ হলো- একই সময়ে এ খাতে ব্যক্তি আমানতকারীর সংখ্যা অস্বাভাবিক কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালের শেষ তিন মাসে এ খাতে ব্যক্তি আমানতকারীর অ্যাকাউন্ট কমেছে প্রায় সাড়ে ৫১ হাজার। তিনটি কারণে এ খাত থেকে আমানতকারী মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এগুলো হলো- আস্থাহীনতা, সুদের সর্বোচ্চ সীমা আরোপ ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি।
অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের অনিয়ম, জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে আগেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা কমেছে মানুষের। এর মধ্যেই এ খাতে আমানত ও ঋণের সুদে সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়তে থাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে মানুষের। এসব কারণে ব্যক্তি আমানতকারীর হিসাব কমে থাকতে পারে।
বর্তমানে দেশে ৩৪টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু আছে। এর মধ্যে তিনটি সরকারি, ১২টি দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় এবং বাকিগুলো দেশীয় ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত। এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি বাদে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই রয়েছে তারল্য সংকটে। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অন্তত ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এখন নাজুক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা আর্থিক খাতের বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা, সমস্যা ও নতুন নতুন যেসব চ্যালেঞ্জ আসছে তারই প্রতিফলন। ব্যাংকের ক্ষেত্রে যেমন খেলাপিরা টাকা ফেরত না দিলেও তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও একই আচরণ দেখা যাচ্ছে। এখানেও পরিচালক ও কর্মকর্তারা যোগসাজশে নামে-বেনামে ঋণের টাকা তছরুপ করে পালিয়ে গেছেন। ফলে এ খাতের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস ও সন্দেহ বেড়েছে, টাকা রাখলে ফেরত পাওয়া যাবে কিনা এই ভয় ঢুকে গেছে। এর মধ্যেই আমানতের সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ক্যাপ দেওয়ায় গ্রাহকরা আরও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন।
জানা যায়, গত বছরের এপ্রিলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়ে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে ঋণে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ এবং আমানতে ৭ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যা ওই বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা বলা হয়। খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আমানতের সুদের হার বেঁধে দেওয়ার কারণে ব্যক্তি আমানতকারীরা এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) সাবেক চেয়ারম্যান ও আইপিডিসি ফাইন্যান্সের এমডি মমিনুল ইসলাম বলেন, মাত্র তিন মাসে এই পরিমাণ ব্যক্তি আমানতকারীর অ্যাকাউন্ট কমে যাওয়ার বিষয়টিকে আমার কাছে একটু অস্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। কারণ এ সময় এমন কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেনি যে, আমানতকারীরা দলবেঁধে চলে যাবে। তা ছাড়া এ সময়ে সার্বিক আমানতের পরিমাণ কিন্তু কমেনি। তিনি বলেন, আমানতের সুদে সীমা বেঁধে দেওয়ার পর এ খাতে আমানত আসা কিছুটা কমে যায়। তবে সব প্রতিষ্ঠানের আমানত ও গ্রাহক কমেছে তা নয়। আইডিএলসি, আইপিডিসিসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আমানত ও গ্রাহক কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বাড়ছে। তবে এটাও ঠিক, খারাপ প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তাদের থেকে মানুষজন আমানত তুলে নিয়েছেন।
এই খাতের ওপর মানুষের আস্থা বাড়ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তদারকির কারণে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে গ্রাহকের আস্থাও বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মিলে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ২১ হাজার ৫৫৯টি, যা ওই বছরের সেপ্টেম্বরেও ছিল ৫ লাখ ৭০ হাজার ১৯৬টি। ফলে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর- এই তিন মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের মোট আমানতকারী গ্রাহক কমেছে প্রায় ৪৮ হাজার ৬৩৭ জন। একই সময়ে শুধু ব্যক্তি আমানতকারী কমেছে ৫১ হাজার ৬৪২ জন। অর্থাৎ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এ খাতে ব্যক্তি আমানতকারীর হিসাব ছিল ৫ লাখ ৪০ হাজার ৯০৬টি, যা গত ডিসেম্বরে কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৯ হাজার ২৬৪টি। এর মধ্যে পুরুষ আমানতকারী কমেছে ৩৬ হাজার ৭৮৮ জন। আর মহিলা আমানতকারী কমেছে ১৪ হাজার ৮৫৪ জন।
তবে ব্যক্তি আমানতকারীর সংখ্যা কমলেও সার্বিকভাবে গত তিন মাসে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে এ খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা, যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল ৪১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে ২ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। তবে এর আগের চার প্রান্তিকে এ খাতে টানা আমানতের পরিমাণ কমতে দেখা গেছে। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০২২ সালের শেষ তিন মাসে আট বিভাগের মধ্যে শুধু ঢাকা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আমানত বেড়েছে। তবে অপর ৫টি তথা চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে আমানত কমে গেছে।
অন্যদিকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৭০ হাজার ৩২১ কোটি টাকা, যা ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ৬৯ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে এ খাতে ঋণ বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মে জর্জরিত এ খাতে খেলাপি ঋণও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের রও এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। তিন মাস আগে ওই বছরের জুনে ৬৯ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বিতরণ করা ঋণের মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, আস্থাহীনতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তি গ্রাহকরা আমানত তুলে নিচ্ছেন। এ কারণে অ্যাকাউন্ট কমেছে বলে মনে হয়। তবে একই সময়ে বড় বড় করপোরেট গ্রাহকদের আমানত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঢুকেছে। এ কারণে সার্বিক আমানত বেড়েছে।