কাগজে ফিট বাস্তবে আনফিট

কাগজে ফিট বাস্তবে আনফিট

দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ মিলছে না। প্রতিনিয়ত হতাহতের ঘটনা ঘটছে। মাদারীপুরের শিবচরে এক্সপ্রেসওয়েতে ১৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ওই ইমাদ পরিবহনের বাসটিরও ফিটনেস নেই। গত ১৮ জানুয়ারি বাসটির ফিটনেস সনদের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।

বিআরটিএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৬ লাখ ৬১ হাজার ৪১৮। আর দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি বলে জাতীয় সংসদকে জানিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে মন্ত্রী এ তথ্য জানান। মালিকদের এসএমএসের মাধ্যমে ফিটনেস করার তাগাদা, সার্কেল অফিস থেকে নবায়নের ব্যবস্থার পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অর্থদ-, কারাদ- ও ডাম্পিংসহ নানামুখী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। এরপর বিআরটিএ অফিসে গতকাল খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশে প্রায় ৫ লাখ গাড়ি ফিটনেসবিহীন।

এ বিষয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি হিসাবে গড়ে বলা হয় ৫ লাখ। কারিগরিভাবে কতগুলো গাড়ি আনফিট তা নির্ণয়ের প্রক্রিয়া চলছে। নবায়নের ফি পরিশোধ না করার হিসাব থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বলা হয়; আদতে এটি সঠিক নয়। প্রাইভেট অনেক গাড়ি কোনো কারণে যথাসময়ে ফি দিতে পারেনি। সেগুলোও কিন্তু ওই ৫ লাখের তালিকায় আছে। তাই প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়ে কাজ চলছে।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবমতে, মোট যানবাহনের মধ্যে ফিটনেসবিহীন বাস ২০ শতাংশ, ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ২০-২৫ শতাংশ, পিকআপের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ হতে পারে। আর নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত হিউম্যান হলারের ৮০ শতাংশই ফিটনেসবিহীন।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মাদারীপুরের শিবচরে দুর্ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে গাড়ির চাকা ফেটে যাওয়া, অতিরিক্ত গতি কিংবা চালকের ঘুম- এ তিনটি বিষয় সামনে এসেছে।

যানবাহনের ফিটনেস সনদ থাকলেও বাস্তবে ফিট নেই অনেক গাড়ি। কেবল নবায়ন ফি জমা দিয়ে ফিটনেস সনদ নেওয়া হয়। তাই কী পরিমাণ গাড়ির ফিটনেস নেই তার তথ্য কারো কাছে নেই। শুধু এতটুকু বলতে পারি সাদা চোখে গণপরিবহনের ৯০ ভাগই ফিটনেসবিহীন মনে হয়।

তিনি আরও বলেন, রাস্তার নির্মাণত্রুটি চালকের অবহেলা কিংবা মালিকের অবহেলা থাকতে পারে অধিকাংশ দুর্ঘটনায়। সাধারণ যাত্রীদের সচেতনতার কথা বলা হয়। প্রাইভেট গাড়িতে সিটবেল্ট থাকে, বাণিজ্যিক গাড়িতে তা নেই। যাত্রীদের দোষ দেখছি না। কিন্তু তারা তো কোনো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। তাদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা জরুরি।

দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ না পাওয়া প্রসঙ্গে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে। এখন পর্যন্ত আবেদন করেছেন ছয়জন। যাচাই-বাছাই শেষে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আর এ জন্য গঠিত ট্রাস্টির অধীনে জনবল নিয়োগের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এরপর অফিসও নেওয়া হবে।

২০১৯ সালের ১ নভেম্বর কার্যকর হয় সড়ক পরিবহন আইন। আইনের ৫৩ (১) ধারা অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় মৃত কিংবা আহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে আর্থিক সহায়তা তহবিল রয়েছে। গত ২৭ ডিসেম্বর কার্যকর সড়ক বিধিমালায় অনুযায়ী, প্রতিটি যানবাহনের কাছ থেকে বার্ষিক চাঁদা নেওয়া হচ্ছে তহবিলের জন্য।

চলতি বছরে শুধু মোটরসাইকেলের নিবন্ধন থেকে এককালীন ৬ কোটি ১০ লাখ টাকা চাঁদা এসেছে তহবিলে। সরকারি হিসাবেই বছরের ১০ হাজারের বেশি দুর্ঘটনায় আহত এবং নিহত হয়েছেন। অথচ একজনও ক্ষতিপূরণ পাননি এখনো।

আইনের ৫৪ (৪) ধারায় ট্রাস্টি বোর্ডকে স্বায়ত্ত সংস্থা বলা হয়েছে। কিন্তু এর কার্যালয় নেই। নেই কার্যক্রমও। কারণ আইনে নিজস্ব জনবল নিয়োগের কথা বলা হলেও, তা করা হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সড়কে চলাচলের জন্য যে কোনো যানবাহনের যান্ত্রিক ও কাঠামোগত ফিটনেস থাকতে হয়। কাঠামোগত দিকটি চোখে দেখে দেওয়া গেলেও যান্ত্রিক দিক পুরোপুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়া দেখভাল করার মতো প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ও পদ্ধতিগত সক্ষমতা বিআরটিএর নেই। এ ক্ষেত্রে সংস্থাটির আন্তরিকতার অভাবের পাশাপাশি লোকবল সংকটও রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে ফিটনেসবিহীন গাড়িকে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ আছে। বিআরটিএ অধিকাংশ যানবাহনের পরীক্ষার সনদ দেওয়া হয় ৫-১০ মিনিটে। এ ছাড়া অনেক গাড়ি না দেখেও ফিটনেস সনদ দেওয়ার অভিযোগ আছে বিআরটিএ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া মোটরযান পরিদর্শকের সংকটও আছে।

সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে, একটি বাসের ফিটনেস সনদ দেওয়ার আগে অন্তত ৬০ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা। এর মধ্যে যানবাহনের ওজন, টায়ারের বিট, গতি ও ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তা মূল বিষয়। বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে এই ব্যবস্থা যন্ত্রের সাহায্যে (ভেহিকল ইন্সপেকশন সেন্টার-ভিআইসি) পরীক্ষা করার সুযোগ আছে। অন্যান্য স্থানে মোটরযান পরিদর্শকরা খালি চোখে পরীক্ষা করেন। এ ছাড়া যানবাহনের ইমিশন (ধোঁয়া নির্গমন), হেডলাইট, রং, আসন ইত্যাদি পরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে।

বিআরটিএর হিসাবে, দেশে নিবন্ধিত মোট মোটরযানের সংখ্যা সাড়ে ৫৬ লাখের কিছু বেশি। মোটরযান চালকের লাইসেন্স আছে ৫০ লাখের কম। অর্থাৎ নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যার চেয়েও লাইসেন্স কম। যদিও যত লাইসেন্স, তত চালক নেই। কারণ, একজন ব্যক্তির একাধিক ধরনের লাইসেন্স থাকতে পারে। যেমন কেউ মোটরসাইকেল এবং হালকা যানবাহনের লাইসেন্স নিলে দুটি লাইসেন্স হিসেবে গণ্য হবে। এ বিবেচনায় দেশে যানবাহনের চেয়ে চালকের সংখ্যা অনেক কম।

বিআরটিএর হিসাবে, লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ৪০ লাখের মতো। অথচ বিআরটিএর পূর্বাভাস হচ্ছে বর্তমানের হারে নিবন্ধন চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ যানবাহনের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এ সময় চালকের প্রয়োজন পড়বে প্রায় দেড় কোটি। কারণ, একটি দূরপাল্লার কিংবা বাণিজ্যিক যানবাহনে একাধিক চালক দরকার। ফিটনেস প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে করা না গেলে যানবাহনের কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে সড়কে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে, সেটি দুর্ঘটনা বলা যাবে কিনা তা নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। এটির একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে আমলে নেওয়া উচিত।

ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচলের কারণ জানতে চাইলে বিআরটিএ বলছে, এটি পুলিশ বিভাগের দায়িত্ব। তারা এনফোর্স করে। আর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে অভিযান চালায় পুলিশ। সনদ ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি পেলে ডাম্পিং করা হয়, মামলা দেওয়া হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানবাহনের মালিকদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগটা যথাযথভাবে করতে হবে বিআরটিএকে। অন্যথায় আনফিট বা ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। এতে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনাও বাড়বে। এ জন্য বিআরটিএকে অভিযান আরও জোরদার করতে হবে। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হবে। মৃত্যুর মিছিল থামাতে এর বিকল্প নেই।

ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে আইনে বলা হয়েছে, সরকারি অনুদান, যানবাহনের কাছ থেকে পাওয়া চাঁদা এবং এই আইনের অধীনে আদায় করা জরিমানার টাকা জমা হবে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় গঠিত তহবিলে। সড়ক পরিবহন বিধিমালার ১৪৯ ধারায় বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে তার পরিবার অন্যূন ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। অঙ্গহানিতে ক্ষতিপূরণ পাবেন অন্যূন ৫ লাখ টাকা। স্থায়ী পঙ্গুত্বের জন্য জন্য ৩ লাখ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সম্ভাবনা থাকলে ১ লাখ সহায়তা পাবেন দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তি। তবে সরকারের অনুমোদনে সহায়তার অঙ্ক কমবেশি করতে পারবে ট্রাস্টি বোর্ড।

বিধিমালার ১৪৩ ধারায় বলা হয়েছে, বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, প্রাইম মুভার জন্য বছরে ১ হাজার ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হবে। নতুন অবস্থায় নিবন্ধন এবং প্রতি বছর গাড়ির কাগজ হালনাগাদের সময় এই চাঁদা নিচ্ছে বিআরটিএ। মিনিবাস, মিনিট্রাক, পিকআপের বার্ষিক চাঁদা ৭৫০ টাকা। কার, জিপ, মাইক্রোবাসের বার্ষিক চাঁদা ৫০০ টাক। তিন চাকার গাড়ি এবং অন্যান্য যানবাহনের বার্ষিক চাঁদা ৩০০ টাক। তবে ট্যাক্স টোকেন এবং ফিটনেস যেহেতু বছরে বছরে হালনাগাদ করতে হয় না, তাই নিবন্ধনের সময় মোটরসাইকেলের কাছ থেকে এককালীন ১ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে।

জাতীয়