নির্বাচন কমিশন সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করলেও পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে খুব একটা উত্তাপ নেই রাজনীতিতে। মেয়র পদে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগে আনুষ্ঠানিক কোনো তৎপরতা নেই। বিএনপিও চুপচাপ। তারা এই নির্বাচনও বর্জন করবে। তারপরও দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
আগামী মে থেকে জুনের মধ্যে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে, এ বছরের শেষ সপ্তাহ কিংবা আগামী বছরের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নীতিনির্ধারক নেতা সমকালকে বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সব নির্বাচনই অবাধ ও নিরপেক্ষ হচ্ছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটি বেশ স্বস্তির। তবে স্থানীয় সরকারের কয়েকটি নির্বাচনে দলের প্রার্থীরা আশানুরূপ ফল পাননি বলে কিছুটা অস্বস্তিও রয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থীর যন্ত্রণাও ছিল অপ্রত্যাশিত। সেই সঙ্গে নির্বাচন বর্জনে থাকা বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-সমর্থকরা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থন দিয়ে ফল বদলে দিচ্ছে। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে এই বিষয়গুলো নতুন করে বিচার-বিশ্লেষণ করা হবে। আর আওয়ামী লীগ নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে জয় আসবেই।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সমকালকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চলমান উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখতে পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও ভোটাররা আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থীদের বিপুল ভোটে জয়ী করবে। আর নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর প্রার্থী মনোনয়নের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য বলেছেন, নির্বাচনে না এলেও পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ঘিরে ইস্যু সৃষ্টির অপচেষ্টা করবে বিএনপি। এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে। সরকারের বিরুদ্ধে জনপ্রিয়তা হারানোর কল্পিত অভিযোগ আনবে। কিন্তু তাদের এ সব সুযোগ কিছুতেই ছাড় দেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সৎ, দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। আর ভোটাররা অবশ্যই গত নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনেও উন্নয়নের প্রতীক নৌকায় ভোট দেবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, বেশ সতর্কতার সঙ্গেই পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক ভোটের হিসাব-নিকাশও থাকবে সেই বিবেচনায়।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে শতভাগ সক্রিয় থাকবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আদর্শিক জোট ১৪ দল। এর মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জোটভিত্তিক নির্বাচনী প্রচারের মহড়াও হবে।
অবশ্য ১৪ দলের শরিক রাজনৈতিক দলের কোনো নেতা পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জোটগত মনোনয়ন পাবেন না বলে জানা গেছে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত শরিকদের কেউ প্রার্থী হওয়ার আগ্রহও দেখাননি। শুধু আওয়ামী লীগেই প্রার্থিতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
রাজশাহীতে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন বর্তমান মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তবে তিনি কিছুটা দোটানায় রয়েছেন। আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চান তিনি। আবার মেয়র পদেও আগ্রহ রয়েছে। এই অবস্থায় তিনি দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন। তিনি মেয়র পদে মনোনয়ন না পেলে এই পদে সম্ভাব্য প্রার্থীর সংখ্যা অনেক হবে। তবে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এ সদস্যই মেয়র পদে মনোনয়ন পাবেন বলে মনে করছেন অনেকে। খায়রুজ্জামান লিটন মেয়র পদে দলের মনোনয়ন চাইলে আর কেউ প্রার্থী হবেন না বলেই দলের ভেতরে আলোচনা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন বলেছেন, নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর মেয়র পদে দলের প্রার্থিতা নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হবে।
খুলনার মেয়র ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক আবারও দলের মনোনয়ন পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে দলীয় প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করেছেন খুলনা-২ আসনে আওয়ামী লীগের এমপি শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল। সাবেক এই মন্ত্রীর সঙ্গে দলের কোনো সম্ভাব্য প্রার্থী নেই। খুলনায় কে প্রার্থী হচ্ছেন, এটা জানতে চাইলে অপেক্ষার পরামর্শ দেন খুলনা বিভাগের সাংগঠনিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক।
তবে অন্যান্য সিটির চেয়ে সিলেটের চিত্র আলাদা। এই সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নতুন মুখ আসবে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বেশ এগিয়ে রয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা কার্যক্রমও শুরু করেছেন। তাঁর মনোনয়নের বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হওয়ায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকেই নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। তবে কেউ কেউ সম্ভাব্য প্রার্থিতার কথা জানান দিয়ে পোস্টার-ফেস্টুন ছেপেছেন। তাদেরই একজন আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন সিরাজ।
এ ছাড়াও সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক জাকির হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ ও এটিএম হাসান জেবুল এবং সাবেক প্রয়াত মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের ছেলে ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আরমান আহমদ শিপলু।
প্রার্থী বাছাই প্রসঙ্গে সিলেট বিভাগের সাংগঠনিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না। সম্ভাব্য প্রার্থীরা কাজ করছেন। তাঁদের মধ্য থেকেই দক্ষ প্রার্থী খুঁজে নেওয়া হবে।
বরিশালের মেয়র ও বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গে প্রকাশ্যে দলের কোনো প্রার্থী নেই। তবে তিনি দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন না বলেই গুঞ্জন রয়েছে। এ ব্যাপারে দলের বরিশাল বিভাগের কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেছেন, প্রার্থিতা নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়নি। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন।
তবে বরিশাল সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে দলের প্রার্থিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিকল্প চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে বলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন। তবে নেতাদের কেউই এই বিষয়টি কিছুতেই স্পষ্ট করছেন না।
এদিকে, গাজীপুরের বহিষ্কৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বেশ বেকায়দায় পড়েছেন। দলীয় বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হলেও মেয়র পদে মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় তিনি পিছিয়ে রয়েছেন। এই সিটি করপোরেশনে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খানের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে গুঞ্জন রয়েছে। এখানে আরও সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন গাজীপুর মহানগর যুবলীগের আহবায়ক কামরুল আহসান রাসেল।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেছেন, প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য হোম ওয়ার্ক চলছে পুরোদমে। জনপ্রিয়তা পরখ করেই যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে।