বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

মহান স্বাধীনতা দিবসের এই মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে স্মরণ করি। তিনি শুধু বাংলাদেশের নন, আন্তর্জাতিক বিশ্বের মহান নেতা। তিনি প্রথমে নিজকে, পরে আওয়ামী লীগকে, তারপর বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে তৈরি করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি উপলব্ধি করেন এ পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে ১৩টি মূল্যবান বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন।

মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের একপর্যায়ে স্বাধিকারের দাবিতে ছয় দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করলে তার কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ অর্থাৎ আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। তখন বাংলার জাগ্রত ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশব্যাপী গণআন্দোলন গড়ে তুলে সর্বাত্মক গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে আসাদণ্ডমতিউর-মকবুল-রুস্তমণ্ডআলমগীর-সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. সামসুজ্জোহাসহ অনেক শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে স্বার্থান্বেষী মহল কুতর্ক জারি রেখেছে। ৭০-এর নির্বাচনে যদি বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ না করতেন বা যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেতেন, তাহলে স্বাধীনতা ঘোষণা করার সুযোগ পেতেন না অথবা হয়তো পেতেন তবে অনেক পরে।

বঙ্গবন্ধুকে অনেকেই বলেছিলেন, লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফওর) অধীনে নির্বাচনে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এলএফও! এ নির্বাচনকে গণভোট হিসেবে আখ্যায়িত করে আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব এবং প্রমাণ করব কে এ দেশের নেতা। আর নির্বাচনের পর আমি এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব।’

এলএফওতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব মেনে নেওয়া হয়। জাতীয় পরিষদে ৩১৩ আসনের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে আমরা পেলাম ১৬৯ আসন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যাতে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে না পারেন সেজন্য এলএফওতে বিতর্কিত ২৫ ও ২৭নং দুটি অনুচ্ছেদ সন্নিবেশ করেন। এলএফওতে সন্নিবেশ করা দুটি ধারাই ছিল আসন্ন নির্বাচনে বিজয়ী দলকে ঠেকানোর অপপ্রয়াস।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু সত্যিকার অর্থেই নির্বাচনকে গণভোটে রূপান্তরিত করে বিজয়ী হন। নির্বাচনের পরপরই ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত ১৬৭ জন এমএনএ ও ২৮৮ জন এমপিএকে নিয়ে শপথ অনুষ্ঠান করে বলেছিলেন, ‘এই গণভোটের মাধ্যমে ছয় দফা আজ আমার না, আমার দলেরও না, ছয় দফা আজ জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। যদি কেউ ছয় দফার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে তাকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ এভাবে তিনি ছয় দফাকে আপসহীন অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু জানতেন ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না এবং তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করবে। সেজন্য বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগিয়েছেন। ১ মার্চ যখন ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন, মানুষ রাজপথে নেমে আসে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার এক মোহনায় দাঁড় করিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তরিত করেন।

নির্বাচনের পরপরই ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২নং-এ ডেকে চার জাতীয় নেতার সামনে আমাদের চারজনকে মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই ও আমাকে একটি ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ভারতে গেলে আমরা কোথায় আশ্রয় পাব, থাকব, সেজন্য আমাদের চার টুকরা কাগজ দিয়ে বলেছিলেন মুখস্থ করো।

কাগজে ঠিকানা লেখা ছিল, ‘সানি ভিলা, ২১নং রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এই ঠিকানায় আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি। অর্থাৎ বহু আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা করেন। সেই ১৯৬২ সালে তিনি দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা নিয়ে আগরতলা গিয়েছিলেন। আগরতলা মামলা তো মিথ্যা ছিল না।

কিন্তু পরিকল্পনা মতো কাজ হয়নি। আগরতলা মামলায় যারা অভিযুক্ত তারা তো আসলেই স্বাধীনতার জন্য একটি সশস্ত্র পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এটা সত্য। যার জন্য ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ বললে যারা অভিযুক্ত তারা অসন্তুষ্ট হন। তারা বলেন, ‘আমরা তো ষড়যন্ত্র করিনি। আমরা তো দেশের স্বাধীনতার জন্যই একটি পরিকল্পনা করেছিলাম।’

বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তার বড় প্রমাণ ছয় দফা। তিনি বিচক্ষণ নেতা ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে নির্বাচন পেছালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকার সুযোগ পাই। নির্বাচনের দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। সেদিন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি কয়টি আসন পাবেন?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি অবাক হব যদি আমি দুটি আসন হারাই।’ বিস্ময়ের ব্যাপার, দুটি আসনই আমরা হারিয়েছিলাম। একটিতে নুরুল আমিন, অন্যটিতে রাজা ত্রিদিব রায় জয়ী হন।

নির্বাচনের পরই তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেন। এ পরিকল্পনার ছক এঁকেছিলেন যখন তিনি ৬৯-এর অক্টোবরে লন্ডন সফরে যান। সেখানে ভারতীয় প্রতিনিধি ফনীন্দ্র নাথ মুখার্জি, তথা পিএন মুখার্জি যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘মিস্টার নাথ’ বলে সম্বোধন করতামণ্ডবঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লন্ডনে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। যেগুলো পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়ন হয়।

বহু বছর ধরে, আত্মদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি প্রিয়নেতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে শিরোধার্য জ্ঞান করেছে। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত এ ঘোষণাই ৭১-এর ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৬নং প্যারায় অনুমোদিত হয়ে সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করেছে। বঙ্গবন্ধুর এ স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ দুপুর দেড়টায় চট্টগ্রাম বেতার থেকে এমএ হান্নানের কণ্ঠে বারবার প্রচারিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ মার্চের ২৬ তারিখেই শুরু হয়ে গেছে।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

tofailahmed69@gmail.com

জাতীয় রাজনীতি