নিরাপদ খাদ্যের প্রশ্নটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়

নিরাপদ খাদ্যের প্রশ্নটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়

অমল বড়ুয়া

চারদিকে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। খুবই স্বাভাবিক। আয় বাড়ছে না, কিন্তু দেখতে না দেখতে অনেক চড়া হয়েছে দ্রব্যমূল্য। কিন্তু দ্রব্যটাই কম মূল্যে আমরা চাইছি, সেই খাদ্য দ্রব্যটি কি আদৌ আর খাদ্য আছে? মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই খাদ্য। বিশ্বের সব প্রাণীই এই খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল। খাদ্যই মানুষসহ তাবৎ প্রাণীর সুস্থতা, শক্তিমত্তা, মেধা ও মননশীলতার নিয়ামক। আর এই খাদ্যের দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো নিরাপদ খাদ্য আর অন্যটি অনিরাপদ ও ভেজাল খাদ্য। কোনো দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য, অর্থনীতি কিংবা রাজনীতি সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় নিরাপদ খাদ্যের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ক) এবং ১৮ (১) অনুচ্ছেদে নাগরিকদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিত্সাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থাকরণ এবং তাদের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করেছে। মানুষের খাদ্যের জোগান দেওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য রক্ষাও সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত অধিকার। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণে সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ প্রণয়ন করে। এ আইনের অধীনে সরকার বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) নামে একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে নিরাপদ খাদ্যোত্পাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুত, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয়সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে সংবিধানের সেই অন্তর্ভুক্ত অধিকার সংরক্ষণেই কাজ করছে। যাদের লক্ষ্য হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা, খাদ্যশিল্প ও খাদ্য ব্যবসায়ী এবং সুশীল সমাজকে নিয়ে যথাযথ বিজ্ঞানসম্মত বিধিবিধান তৈরি, নিরাপদ খাদ্যোত্পাদন শৃঙ্খল পরিবীক্ষণ এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সংস্থাসমূহের কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে ভোক্তার জীবন ও স্বাস্থ্যের সুরক্ষা দেওয়া। নিরাপদ খাদ্য আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আর্থিক বিধিমালা, ২০১৯’ এবং ‘নিরাপদ খাদ্য (খাদ্য-স্পর্শক) প্রবিধানমালা, ২০১৯’ প্রণয়ন করা হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইনে খাদ্য বলতে,‘চর্ব্য, চুষ্য’, লেহ্য (যেমন—খাদ্যশস্য, ডাল, মৎস্য, মাংস, দুগ্ধ, ডিম, ভোজ্য তেল, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি) বোঝানো হয়েছে। ‘পেয়’ হিসাবে (সাধারণ পানি, বায়ুবাহিত পানি, অঙ্গারায়িত পানি, এনার্জি ড্রিংক ইত্যাদি)সহ সব প্রকার প্রক্রিয়াজাত, আংশিক-প্রক্রিয়াজাত বা অপ্রক্রিয়াজাত আহার্য উৎপাদন বোঝানো হয়েছে।

 

তবে এত আইনকানুন প্রণয়নের পরও নিরাপদ খাদ্য এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেস্ক বা বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা সূচক-২০২০-এ ১১৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। ২০১৯ সালে অবস্থান ছিল ৮৩তম। শুধু বৈশ্বিকভাবেই নয়, সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে। কারণ দেশের বেশির ভাগ খাদ্য ও পানি ভেজাল, নিম্নমানের। ২০১৮ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, দেশে বিভিন্ন উপায়ে সরবরাহ করা খাবার পানির ৪১ শতাংশ ডায়রিয়ার জীবাণু বহন করছে। পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা ৮০ শতাংশ পানিতে আছে ক্ষতিকর জীবাণু। শহরাঞ্চলে পাইপলাইনে সরবরাহ করা ট্যাপের ৮০ শতাংশ পানিতে ক্ষতিকর জীবাণু ই-কোলাই রয়েছে। খাদ্যদূষণের কারণ বিবিধ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফসলে কীটনাশক ব্যবহার, গরু পালনে বাণিজ্যিক খাদ্য ও ওষুধের ব্যবহার, মুরগি পালনে বাণিজ্যিক খাদ্য ও ওষুধের ব্যবহার, খাদ্য প্রক্রিয়ায় রাসায়ানিক পদার্থের ব্যবহার, খাদ্য তাজা রাখার জন্য রাসায়ানিক সারের ব্যবহার ও খাদ্য সুন্দর করার জন্য রঙের ব্যবহার। উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ, বিপণন সর্বক্ষেত্রে খাবার অনিরাপদ হতে পারে। খাদ্যদূষণের কারণে বাড়ছে রোগ-ব্যাধি ও মৃত্যু। ৪১ শতাংশ অসুস্থতার কারণ ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিস, স্ট্রোক বা উচ্চরক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার, কিডনি রোগ। মাত্র এই ছয়টি রোগ ৫৪ শতাংশ মৃত্যুর কারণ। ফরমালিন, কার্বাইড ও কাপড়ের রং খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে। খাদ্য যেমন আমাদের বাঁচিয়ে রাখে আবার মারতেও পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, রাসায়নিক দ্রব্য এবং অন্যান্য দূষণমূলক পদার্থ প্রায় ২০০-এর বেশি রোগের সৃষ্টি করে, যার মধ্যে ডায়ারিয়া থেকে শুরু করে ক্যানসারও রয়েছে। খাদ্যদূষণের কারণে বাংলাদেশে ৩০ শতাংশ লোক অসুস্থ হয় খাদ্যজনিত রোগে। ভোজ্য তেল এবং ডালডা-বনস্পতির মাত্রাতিরিক্ত ট্র্যান্স ফ্যাট গ্রহণকে (টিএফএ) হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী ভোজ্য তেলে এই টিএফএ-এর নির্ধারিত মাত্রা হচ্ছে ২ গ্রাম/১০০ গ্রাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভেজাল খাবার খেয়েই বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার মানুষ বিভিন্ন রোগে সংক্রমিত হয়। এদের মধ্যে ৪০ শতাংশই রয়েছে পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা। সে অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু ভেজাল খাবার খেয়ে মারা যায়।

ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির গবেষণায় কৃষিপণ্যের মধ্যে ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিকের অস্তিত্ব মিলেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে তা বের হতে পারে না। সব কটিই দীর্ঘ মেয়াদে কিডনি, লিভার ও মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া ক্যানসারসহ নানা ধরনের ক্রনিক রোগের বড় উৎস হচ্ছে এসব রাসায়নিক। এগুলো ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ইউরোপীয় কমিশনের নীতিমালা অনুসারে মানবদেহের জন্য ক্রোমিয়ামের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ১ পিপিএম। জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের গবেষণায় চালে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে ৩ দশমিক ৪১৪ পিপিএম পর্যন্ত। ক্যাডমিয়ামের সহনীয় মাত্রা শূন্য দশমিক ১ পিপিএম হলেও গবেষণায় পাওয়া গেছে ৩ দশমিক ২৩৯৫ পিপিএম পর্যন্ত। সিসার সহনীয় মাত্রা শূন্য দশমিক ২ পিপিএম হলেও পাওয়া গেছে ১ দশমিক ৮৭ পিপিএম পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালে ক্যাডমিয়ামের প্রধান কারণ জমিতে নিম্নমানের টিএসপি সার প্রয়োগ এবং গার্মেন্টস শিল্প, ওষুধ কারখানা, টেক্সটাইল ও ট্যানারির অপরিশোধিত বর্জ্য। তাদের মতে, পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের পরিণতি কমবেশি সবাইকেই ভোগ করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা।

কৃষি অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনের হিসাব মতে, বাম্পার ফলনের জন্য ফসল উৎপাদনে ২২ লাখ ৬৯ হাজার ২২৬ মে. টন ইউরিয়া, ৫ লাখ ৮৫ হাজার ১০৭ মে. টন টিএসপি, ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮২৩ মে. টন এমওপি, ৫ লাখ ১৬ হাজার ১১৬ মে. টন ডিএপি এবং ২ লাখ ৮৬ হাজার ২৮১ মে. টন জিপসাম ব্যবহার করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখার তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে আট ধরনের ২২৮টি মাকড়ানাশক, ৭৯ ধরনের ১০১৫টি ছত্রাক নাশক, ১১৭ ধরনের ২ হাজার ৫৮৮টি কীটনাশক, ৫১ ধরনের ৬৯১টি আগাছানাশক, দুই ধরনের ১৩টি ইঁদুরনাশক, ৮৮ ধরনের ৭১৭টি জনস্বাস্থ্য কীটনাশক বিষ বাজারে রয়েছে। এছাড়াও ১৮টি নেমাটোডনাশক এবং গুদামজাত শস্যের পোকা দমনের জন্য চার ধরনের ৮৯টি বিশেষ কীটনাশক রয়েছে। মোট ৩৫৯ ধরনের ৫ হাজার ৩৫৯টি বালাইনাশক বা পেস্টিসাইট বাজারে বিদ্যমান আছে। উল্লেখ্য, কীটনাশকের ৬০ শতাংশ ব্যবহার হয় ধান উৎপাদনে। আর বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ধান থেকে উৎপন্ন ভাত। আর ভাতের মাধ্যমে বছরে আমরা প্রায় ৫৪ গ্রাম বিষ খাচ্ছি, আমাদের সন্তানদের খাওয়াচ্ছি। ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১২টি কীটনাশককে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ করে ‘ডার্টি ডজন’ কীটনাশক নাম দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন মতে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা ২০১৫ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৬ হাজার ৩৬০টি খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করেন। তারা সেগুলো মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ফুড টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে পাঠান। সংগৃহীত ঐ নমুনার মধ্যে ১ হাজার ৯৭৮টিতে, অর্থাৎ ৩১ দশমিক ১০ শতাংশ খাদ্যপণ্যে ভেজাল পাওয়া যায়। নিরাপদ খাদ্যের জন্য মাটি, পানি ও ফসলকে বিষমুক্ত রাখার প্রযুক্তি ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করা ও এর সঠিক প্রয়োগ প্রয়োজন। তার সঙ্গে দরকার খাদ্য-শস্য উৎপাদনে বিষ-কীটনাশক-সার ও রাসায়নিকের ব্যবহারে সতর্ক হওয়া, খাদ্যে ভেজাল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। অতি মুনাফালোভী, অসাধু ব্যবসায়ী, ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে ভেজালবিরোধী অভিযান চলমান রাখা। আর সঙ্গে সরকারি তদারকি প্রতিষ্ঠান, মান নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সুশীল সমাজ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ভেজালের বিরুদ্ধে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি জ্ঞাননির্ভর সুখী, সুন্দর, সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনে নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই।

লেখক : প্রাবন্ধিক

মতামত