মৃত্যু এই জগতের সবচাইতে বড় সত্য। বিশ্বখ্যাত লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে মৃত্যু লইয়া যাহা বলিয়াছেন, তাহার সারমর্ম হইল—মৃত্যু লইয়া আমার কোনো ভয় নাই, কারণ আমি জন্মগ্রহণ করিবার পূর্বেও মৃত্যুর মতোই একটি শূন্য জগতে ছিলাম। সেই জগৎ লইয়া আমার কোনো ভয় ছিল না। আমরা মৃত্যু লইয়া রচনা লিখিতে বসি নাই। আমরা মূলত বলিতে চাহিতেছি, জগতের চারিদিকে যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি, বিভিন্ন অস্ত্রের চোখ রাঙানি, শক্তিশালীদের চমকানি-ধমকানি, শাসানি—কিন্তু তাহারা কেহ কি চিরকাল বাঁচিয়া থাকিতে পারিবেন? পারিবেন না।
মুশকিল হইল—যাহারা বিপুল ক্ষমতাশালী হইয়া যান—তাহাদের মনোজগৎ অন্যরকম হইয়া যায়। তাহারা যেন মৃত্যুর অতীত! ক্ষমতার অতি উষ্ণ প্রতাপে অনেকেই মনে করেন, তাহারা যেন অমর! কিন্তু তাহারা যদি প্রতিক্ষণ স্মরণে রাখিতেন—রাতে ঘুমাইতে যাইতেছি, সেই ঘুমই শেষ ঘুম হইতে পারে; যেই খাবারটা খাইতেছি—সেই শেষ খাবার হইতে পারে। মহান আল্লাহ তায়ালা (সুরা নিসা, আয়াত ৭৮) ঘোষণা করিয়াছেন—তোমরা যেইখানেই থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাইবেই, যদিও তোমরা কোনো শক্ত ও সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করো।’ মহানবি রসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করিয়াছেন—‘আদম সন্তান বৃদ্ধ হইয়া যায়; কিন্তু তাহার দুইটি বিষয় অবশিষ্ট থাকে—লোভ ও আশা।’ যাহার ফলে মৃত্যু না আসা পর্যন্ত মনে হয় মৃত্যু তুচ্ছ বিষয়। যদিও প্রতিদিন হাজারো অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর খবর তাহার কানে আসে; কিন্তু হাজারো অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর খবর শুনার পরই ভাবে তাহার মৃত্যুর সময় হয়তো এখনো হয় নাই। সে নানাভাবে মৃত্যুর কথা ভুলিয়া থাকে, মৃত্যু হইতে পালাইতে চাহে; কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলিয়াছেন, ‘আমি তোমাদের মৃত্যুর সময় ঠিক করিয়া দিয়াছি।’ (সুরা ওয়াকিআহ :৬০)। মুশকিল হইল, ক্ষমতাবানরা ভুলিয়া যান ধর্মের কথা, জগতের পরম সত্য কথা। তাহারা যদি এই সত্য সর্বদা মনে রাখিতেন, তাহা হইলে পৃথিবীর ইতিহাসও আজ অন্যরকম হইতে পারিত। হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া অসভ্য অবস্থা হইতে মানুষ যতই সভ্য হইয়া উঠুক না কেন—‘মানুষ মানুষের জন্য’—এই সত্যটি সবচাইতে অধিক উপেক্ষিত থাকিয়াছে।
অমরত্ব লাভের মানসে প্রাচীনকালে রাজা-মহারাজারা বিভিন্ন কেমিস্ট নিয়োগ করিতেন অমৃতসুধা আবিষ্কারের জন্য। খ্রিষ্টপূর্ব দুই শত বৎসর পূর্বেকার চীনের মহাপরাক্রমশীল সম্রাট কিন শি হুয়াং মৃত্যুর কথা চিন্তাই করিতে পারিতেন না।
তিনি চাহিতেন তাহার রাজ্যের বিজ্ঞানীরা শুধু অমরত্বের রহস্য অনুসন্ধানেই ব্যস্ত থাকুক, অন্য সকল কিছুই তাহার নিকট ছিল সময়ের অপচয়। অমরত্বের সুধা বানাইবার ব্যর্থতার দায়ে তিনি প্রায় সাড়ে চার শত বিজ্ঞানীকে জীবন্ত কবরও দিয়াছিলেন। তাহার পরও অমরত্ব সুধা হুয়াংকে অমরত্ব দান করিতে পারে নাই। তাহার মৃত্যুর পর মৃতদেহটিকে পচা মাছ দিয়া ঢাকিয়া দেওয়া হইয়াছিল যাহাতে মৃতদেহের পচা গন্ধ চাপা পড়িয়া যায়। জীবিতাবস্থায় কিন শি বড় গলায় বলিতেন—তাহার বংশধরেরা সহস্র অযুত বৎসর রাজ্য শাসন করিবে। অথচ বিধাতার নির্মম পরিহাস হইল—তাহার মৃত্যুর মাত্র তিন বৎসরের মাধ্যেই তাহার বংশের আস্ফাালন চিরতরে শেষ হইয়া যায়। বস্তুত এই আধুনিক সময়েও মৃত্যু বিষয়টি কিছুতেই মানিয়া লইতে পারেন না পৃথিবীর কিছু শাসক-সম্রাট-জ্ঞানীগুণী-প্রতাপশালী ব্যক্তিরা। এই জন্য তাহারা যে কোনো উপায়ে নিজের নামখানি খোদিত করিয়া রাখিতে চাহেন। পৃথিবী জুড়িয়া চারিদিকে এত যে ভাস্কর্য, এত যে নামফলক—তাহারা নেপথ্যে ঐ অমরত্বেরই সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা কাজ করিয়া থাকে।
প্রকৃত অর্থে মহাকালের নিষ্ঠুর করাল গ্রাসে সবাইকে ক্রমশ বিলীন হইয়া যাইতেই হয়। এই জন্য পৌরাণিক যুগে ঋষির নিকট বসিয়া শিষ্য যখন জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী করিয়া অমর রহিব, গুরুদেব?’ ঋষি উত্তরে বলেন, ‘মানুষের জন্য ভালো কাজ করো বত্স, মানুষের মনে অমর রহিবে।’ অর্থাৎ মানুষ মূলত বাঁচিয়া থাকে তাহার সুকীর্তির মাধ্যমে। এই জন্য সুকীর্তি এত গুরুত্বপূর্ণ।