ভৌগোলিকভাবে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মিজ টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান করায় বাংলাদেশ ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির দিক হতে পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। সম্প্রতি ‘দ্য গ্লোবাল আর্থকোয়াক ডিজাস্টার রিস্ক ইনডেক্স (ইডিআরআই)’ রাজধানী ঢাকাকে বিশ্বের ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ শহরের মধ্যে একটি অন্যতম শহর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট’-এর আওতায় ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওন ১৫২৮ বর্গ কিমি এলাকার সমীক্ষায় নিরূপণ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, টাঙ্গাইলের মধুপুরে দিনের বেলা ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীর ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ (৪০.২৮%) হাজার ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় এ ভূমিকম্প হলে মারা যাবেন ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ, আহত হবেন ২ লাখ ২৯ হাজার। ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে সরকারকে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা।
সিলেটের ডাউকি চ্যুতিরেখায় ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫টি (১.৯১%) ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় ভূমিকম্পটি হলে ১৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। আহত হবেন ২৮ হাজার মানুষ। এই মাত্রার ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকার সমান। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার (সাড়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা)।
৪৭৫ বছরের রির্টান পিরিয়ডের মধ্যে দিনের বেলা ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার কমপক্ষে ৭ লাখ ২৯ হাজার ২৫১টি (৩৩.৯৭%) ভবন ধসে পড়তে পারে। এতে ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করতে পারে এবং ১ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ আহত হতে পারে। এমন ভূমিকম্প হলে ১৭.৬ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৩১.৭ বিলিয়ন ডলার।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২ হাজার ৪৭৫ বছরের রির্টান পিরিয়ডের মধ্যে দিনের বেলা ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ২০ লাখ ৪১ হাজার ৯৮২ (৯৫.১৩%) সংখ্যক ভবন ধসে পড়তে পারে। এতে ৭ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করতে পারে এবং এতে ৪ লাখ ৯৪ হাজার মানুষ আহত হতে পারে। এমন ভূমিকম্প হলে ৭৯.৬ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ১২৪.২ বিলিয়ন ডলার।
রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও ভূমিকম্প পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজউকের উন্নয়ন সদস্য মেজর (ইঞ্জিনিয়ার) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (অব.) ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা শহরে সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-পুলিশ স্টেশনের ভবনগুলোর ওপর জরিপ চালায়। এতে ৩ হাজার ২৫২ ভবনের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট করা হয়। এর মধ্যে ১৮৭ ভবন পাওয়া যায়, যেগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে নিরাপদ করা সম্ভব। আর ৪২টি ভবন এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে সেগুলোকে অপসারণ করার কথা বলা হয়। পর্যায়ক্রমে বেসরকারি ভবনের জরিপও প্রকাশ করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন থেকে ভবন নির্মাণের জন্য সাধারণ নকশার পাশাপাশি কাঠামোগত নকশাও বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে। কাঠামোগত নকশায় মূলত একটি ভবনের বিস্তারিত নকশা, যেখানে ফাউন্ডেশন, পিলার, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাসহ ভেতরের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো কেমন হবে তার নকশাও থাকবে। এই নকশা থেকেই ধারণা পাওয়া যাবে যে নতুন ভবনটি ভূমিকম্প সহনীয় হবে না কী না।’
ঐতিহাসিক রেকর্ড অনুযায়ী, বিগত ১৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ এবং ভারতের আসাম, বিহার, মেঘালয় রাজ্য ও নেপালের আশেপাশে ৯টি বড় মাত্রার ভূমিকম্প (রিখটার স্কেলের ৭ মাত্রা এবং এর অধিক) হয়েছে। ১৮৯৭ সালের ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক’-এ ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর শহরের স্থাপনাসমূহের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং কমবেশি ১ হাজার ৫০০ জন মানুষ মারা যায়।
সম্প্রতি ২০২১ সালে সিলেটে ৭ বার, চট্টগ্রামে ৩ বার মৃদু মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয় এবং অতি সম্প্রতি ২০২২ ও ২০২৩ সালে সিলেট, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, যা অদূর ভবিষ্যতে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক ও সিরিয়ায় ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ও ৫ মাত্রার বেশি ৩১টি আফটার শক হয়, যার ফলে কমবেশি ২ লাখ ২০ হাজার ভবন, ৫৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়, লক্ষাধিক মানুষ আহত হয় এবং ১০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক ক্ষয়ক্ষতি হয় (ইউএনডিপি)।
তুরস্কের দিয়ারবাকিরে ভূমিকম্পের পরে উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন। ছবি: রয়টার্স
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ‘বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি প্রশমন ও প্রস্তুতি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ৮ দশমিক ৩ থেকে ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি প্রশমনে শিক্ষক, গবেষক, নীতিনির্ধারক, গণমাধ্যমকর্মী এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থার পেশাজীবী সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। গৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করতে হবে। ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ঝুঁকি প্রশমনে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে।’