তাইওয়ান এক বিপজ্জনক ত্রিভুজ প্রেমের ফাঁদে আটকে পড়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন মধ্য আমেরিকা থেকে ফেরার পথে যুক্তরাষ্ট্রে একটা বৈঠক করবেন জেনে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে চীন। দেশটি মনে করে, এমন বৈঠক চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষতি করবে। এখন তিনি ক্যালিফোর্নিয়াতে যাচ্ছেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থি তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবেন। খবর বিবিসি।
এমন এক সময়ে সাই যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন যখন চীনের বিরুদ্ধে দেশটির গভীর এবং ক্রমবর্ধমান বৈরিতা দেখা যাচ্ছে। আর এ কারণে তাইওয়ানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি করে প্রকাশ্য সমর্থন দেখাচ্ছে। এক্ষেত্রে ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে যেন রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে।
গত গ্রীষ্মে সাবেক হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি যে তাইপে-তে যাওয়ার জন্য অত উদগ্রীব ছিলেন, তার পেছনেও ছিল এই কারণ। চীনের দিক থেকে এর বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার পরও তিনি এই কাজটা করেছিলেন। স্বশাসিত দ্বীপ তাইওয়ানকে চীন তাদের দেশের অংশ বলে গণ্য করে। কিন্তু এই দ্বীপকে ঘিরেই এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিরোধ তৈরি হয়েছে ।
তাইওয়ানের আমেরিকান ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর উইলিয়াম স্ট্যান্টন বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে পেলোসির এই সফরের বিরোধী ছিলাম”।
তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এরকম উচ্চপদের একজন রাজনীতিক যখন তাইওয়ান সফর করেন, সেটা আসলে চীনকে খোঁচানোর সামিল, এ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কোন কিছু অর্জন করার নেই। আর এর যে পরিণাম হবে, সেটাও কিন্তু বেশ ভীতিকর”।
এই সফরের জের ধরে তাইওয়ানের আকাশের ওপর দিয়ে ছোঁড়া হতে থাকে চীনা ক্ষেপণাস্ত্র, রক্ত হিম করা নানা রকম হুমকিও দিতে থাকে বেইজিং। ঐ অঞ্চলের রাজধানীগুলোতে তখন এমন আলোচনা বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই চলছিল, চীন আসলে কখন তাইওয়ান দখলের জন্য অভিযান চালাবে।
সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর বেইজিংকে বেশ ক্ষুব্ধ করেছিল
কিন্তু তা সত্ত্বেও, গত জানুয়ারিতে যখন ম্যাকার্থি যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ স্পিকার নির্বাচিত হলেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার পূর্বসূরি ন্যান্সি পেলোসির উদাহরণ অনুসরণের ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। তবে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ঠিক করলেন, এটা মোটেই ভালো হবে না, বলছেন প্রফেসর স্ট্যান্টন।
“আমার মনে হয়, এটা বেশ স্পষ্ট যে কেভিন ম্যাকার্থি ন্যান্সি পেলোসির মতো কিছু একটা ঘটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাই ইং-ওয়েন বলেছেন, ধন্যবাদ, আমিই বরং ক্যালিফোর্নিয়ায় আপনার কাছে আসি চা পান করতে, সেটা কেমন হয়”, বলছেন প্রফেসর স্ট্যান্টন।
প্রেসিডেন্ট সাই হয়তো চাননি আরেকজন মার্কিন নেতা এরকম একটা বিতর্কিত সফরে এখন তাইওয়ান আসুক। তবে একই সঙ্গে তার এটা দেখানোও দরকার ছিল যে, চীন যতই চেষ্টা করুক, তারা তাইপের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে বাধা দিতে পারে না।
কাজেই, সেজন্যেই ক্যালিফোর্নিয়ায় এই বৈঠকের আয়োজন। মিস্টার ম্যাকার্থি এই বৈঠকের গুরুত্বকে মোটেই খাটো করে দেখাচ্ছেন না। যদিও চীন হুমকি দিয়ে যাচ্ছে যে, তাইওয়ান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ‘আগুন নিয়ে খেলছে।’
তাইওয়ানের জন্য এরকম তথাকথিত ‘ট্রানজিট কূটনীতি’ অবশ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বলছেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওয়েন-টাই সাং।
বিগত বছরগুলোতে চীন তাইওয়ানের অনেক সাবেক মিত্রকে তাদের পক্ষে নিয়ে এসেছে। তাইপের সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এমন দেশের সংখ্যা এখন মাত্র ১৩টিতে নেমে এসেছে।
“এসব আন্তর্জাতিক সফরের মাধ্যমে আসলে তাইওয়ানের সমাজ তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রয়োজন, সেটাই পূরণ করছে”, বলছেন সাং। “যখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকে না, তখন তাইওয়ানিজদের কাছে এরকম আন্তর্জাতিক সমর্থনের ছায়া-সূচকগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।”
মা এবং তার বোনেরা চীনের মূল ভূখণ্ড সফরের সময় তার পিতামহের সমাধি পরিদর্শন করেন।
এদিকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিও তাইওয়ানের মন জেতার জন্য চেষ্টা শুরু করেছে। তারা প্রেসিডেন্ট সাই এর পূর্বসূরি মা ইং-জিও-কে চীনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
মা চীনের পাঁচটি শহরে এক অভূতপূর্ব সফরে গেছেন, তিনি বলছেন, তার পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এই সফর। চীনের মধ্যাঞ্চলে তাদের সমাধি তিনি পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু এটি আসলে একটি রাজনৈতিক সফরও ছিল। সত্যিকার অর্থে, এই প্রথম তাইওয়ানের কোন সাবেক প্রেসিডেন্ট ১৯৪৯ সালের পর প্রথম চীন সফরে গেলেন।
“বেইজিং চেষ্টা করছে তাইওয়ানের ব্যাপারে তাদের সুর কিছুটা নরম করতে.. যাতে করে তারা তাইওয়ানের আরও বেশি মানুষের হৃদয়-মন জয় করতে পারে, এবং ২০২৪ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সেখানে যাতে জাতীয়তাবাদ আরও মাথাচাড়া না দেয়”, বলছেন সাং।
মা’র সফর, তার মতে, এজন্যে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ছায়া হিসেবে কাজ করেছে। গত সপ্তাহে যখন তিনি নানজিং এ এসে নামেন, মা সেখানে এক সুস্পষ্ট রাজনৈতিক ভাষণ দিয়েছেন।
“তাইওয়ান প্রণালীর দুই দিকের মানুষই চীনা। আমরা সবাই ইয়ান এবং পীত সম্রাটদের বংশধর”, বলেছেন তিনি।
প্রফেসর স্ট্যান্টন বলেন,”বেইজিং মা ইং-জিউ-কে যে এত গুরুত্ব দিচ্ছে তার কারণ আছে, তাইওয়ান যে মাথা নত করছে, তিনি হচ্ছেন তার প্রমাণ। তিনি যখন বলেন, আমরা সবাই চীনা, সেটা তো চীনেরও কথা, এ নিয়ে তার মানে দুপক্ষই একমত। কিন্তু এটার সঙ্গে আবার সব তাইওয়ানিজ একমত নয়।”
মা’র এই কৌশলে একটা ঝুঁকি আছে। তাইওয়ানের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ নিজেদের তাইওয়ানিজ বলে ভাবে, চীনা নয়।
তবে পর্দার আড়ালে হয়তো ভালো কিছুও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, তাইওয়ানের অর্ধেকের বেশি মানুষ বিশ্বাস করে, চীনের সঙ্গে যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম। এবং মা’র লক্ষ্য তাইওয়ানের ভোটারদের এই বলে আশ্বস্ত করা যে, কেবল তার পার্টি- কুওমিনটাং (কেএমটি)- যুদ্ধ এড়াতে পারে, বলছেন সাং।
“তাইওয়ান প্রণালীর দুই দিকের মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে তিনি নিজের একটি স্থায়ী ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান। আর তাইওয়ানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হয়ে যাচ্ছে। কেএমটি যুক্তি দিচ্ছে যে, তারাই চীনের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।