আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে তিনটি অন্যতম। এক. দলের ভেতরে নেতাদের বিভেদ দূর করা; দুই. নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে লাগাম টানা এবং তিন. দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থেকে মোকাবিলা করা। এর মধ্যে দলের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে ঘর গোছানোকেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছে আওয়ামী লীগের থিংকট্যাংক।
এ ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত, অর্থনীতি পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা, আমদানি-রপ্তানি-মুদ্রা ভারসাম্য বজায় রাখা, আইনশৃঙ্খলা ও জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রাখাকেও চ্যালেঞ্জ দেখছে ক্ষমতাসীন দলটি। সে অনুযায়ী দলটির নীতিনির্ধারকরা কাজ করছেন।
আওয়ামী লীগ কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে পুরোদমে কাজ করছে। তৃণমূল সাজাতে রমজানেও ব্যস্ত রয়েছে দলটি। কেন্দ্রের নির্দেশে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করছে দলটি। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্ব পুরনো নেতৃত্বকে বাদ দিচ্ছে। আবার বাদ পড়া নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে আলাদা বলয় তৈরি করে বিপরীতমুখী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। ফলে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়ছে। বলা যায়, আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ এখন আওয়ামী লীগই। এটি খুবই ভাবাচ্ছে দলের থিংকট্যাংকদের।
অভিযোগ আছে, কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতাও তার নিজ এলাকায় পৃথক বলয় তৈরির নেপথ্যে মূল ভূমিকায় রয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে আগামী সংসদ নির্বাচনকালে এটি রীতিমতো দলের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচন ইস্যুতে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের চাপকে কাঁধের বোঝা বলে মনে করছে না আওয়ামী লীগ। কিন্তু উদ্বেগ রয়েছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র নিয়ে, যা থেমে নেই। এ ছাড়া রয়েছে দ্রব্যমূলের উর্ধ্বগতি। এত সব মোকাবিলা আওয়ামী লীগের জন্য এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দল অতীতের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থাকলে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।
আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, গত এক মাসের চিত্রপট থেকে দেখা যায়, প্রভাবশালী দেশগুলো থেকে নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রতি যে চাপ দিচ্ছিল তা এখন অনেকটাই কম। তারা এখন আওয়ামী লীগের বিকল্প কাউকে চাচ্ছেন না কিংবা পাচ্ছেন না এই অবস্থায় আছেন। নানা সমীকরণ দেখিয়ে এসব দেশ থেকে এখন বলা হচ্ছে শেখ হাসিনা ফের ক্ষমতায় আসবেন। ফলে আওয়ামী লীগের কাছে তাদের একটিমাত্র প্রত্যাশা তা হলো- একটি অবাধ,
সুষ্ঠু ও অংগ্রহণমূলক নির্বাচন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যেই কাজ করছে। তবে সংবিধানের বাইরে এক চুলও নড়বে না।
এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের গত তিন মাসের প্রতিবেদন বলছে, গত তিন মাসে সারাদেশে আওয়ামী লীগের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে ৩১ বার। এতে আহত হয়েছেন ৩৬৯ এবং নিহত হয়েছেন ৩ জন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে ১ বার। এতে আহত হয়েছেন ১১ জন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে ১ বার। এতে ২ জন আহত হয়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা ও উপজেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি ও ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের থানা ও ওয়ার্ডে কমিটি ঘোষণার পর দলের মধ্যে বড় প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি নিয়ে বহুদিন ধরেই চলছে নানা আলোচনা। কিন্তু মহানগরের দুই পাশের চার শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে আর্থিক মোহ রয়েছে বলে দলে গুঞ্জন আছে। এ ছাড়া তারা কমিটিতে নিজস্ব বলয় তৈরিতে সচেষ্ট বলেও অভিযোগ রয়েছে। সূত্রের খবর, এসব কারণে দলের হাইকমান্ড তাদের ওপর নাখোশ। এমতাবস্থায় কমিটি ঘোষণা হলে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিক্ষোভ-বিভেদ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
অভিযুক্ত নেতাদের অনেকে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা পাওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছেন- এমন অভিযোগ তৃণমূল নেতাদের। সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, বিদ্রোহীরা ও দলের বিশৃঙ্খল নেতারা ক্ষমা পেয়ে যাওয়ায় আগামী নির্বাচনে অনেকে বিদ্রোহ করতে পারেন, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেন। এতে দলের চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, আওয়ামী লীগের বেশ কজন কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতার এলাকা চাঁদপুর। তাদের প্রায় সবাই মনোনয়নপ্রত্যাশী। ফলে নিজেদের বলয় তৈরির চেষ্টা অব্যাহত রাখছেন তারা। এক্ষেত্রে দলের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ অনেক সময় বড় হয়ে উঠছে। ফলে স্থানীয় বেশ কজন ত্যাগী নেতা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
এমন অবস্থা মাদারীপুরেও। কেন্দ্রীয় সভাপতিম-লীর সদস্য, যুগ্ম সম্পাদক, সম্পাদক ও সদস্য পদের বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বাড়ি মাদারীপুরে। এই নেতৃবৃন্দ দুভাগে ভাগ হয়ে আছেন খোদ দলের রাজনীতিতেই। ফলে সেখানকার রাজনীতি অনেকটা মারমুখী হয়ে উঠেছে। শরীয়তপুরেও একই অবস্থা। গত ৩ অক্টোরর দলের তৎকালীন সদস্য বর্তমান উপপ্রচার সম্পাদক আবদুল আউয়াল শামীম হামলার শিকার হন। হামলাকারীরা একই দলের স্থানীয় নেতা।
তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলে খ্যাত শরীয়তপুর-মাদারীপুরেই শুধু নয়, দলে বিভেদের এই চিত্র এখন সারাদেশে। আর এ কারণে সরকারের এত সব উন্নয়নের সফলতা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকা, দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি কমাতে সরকারকে যার যার অবস্থান থেকে সহায়তা করা এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এখন মূল অঙ্গীকার হওয়া উচিত। কিন্তু এসবে কারও নজর নেই। ফলে সামনের সিটি নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচনেও বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে ক্ষমতাসীন দলটির।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, আমাদের কথা হচ্ছে জনগণের আস্থা অর্জন করা। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করছি। কোনো কিছুকেই আমরা চ্যালেঞ্জ মনে করছি না।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আওয়ামী লীগ অনেক বড় একটি দল। এখানে নেতাকর্মীর সংখ্যা অনেক। ফলে মতবিরোধ দেখা দেয়। কখনো সংঘাতও হয়। দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সাংগঠনিক রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছেন। কোথাও বেশি জটিল অবস্থা দেখা দিলে আমরা দলের সভাপতি আমদের প্রিয় নেত্রীর কাছে পাঠানোর সুপারিশ করি। তিনি উভয় পক্ষকে ডেকে মিলিয়ে দেন। রমজান মাসেও আমাদের নেত্রী বিভিন্ন এলাকার নেতৃবৃন্দকে ডেকে নিয়ে কথা বলছেন। আশা করি নির্বাচনের আগে দলীয় মতবিরোধ বা দ্বন্দ্ব শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের ভাষ্য ভিন্ন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ দেশে চ্যালেঞ্জের বাইরে কোনো সময় পার হয় না। আমি মনে করি, বিশ্ব অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এখন দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা, আমদানি-রপ্তানি- মুদ্রা ভারসাম্য বজায় রেখে মানুষের জীবনে স্বস্তি রক্ষা করা সবচেয়ে বড় এবং কঠিন চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, ‘চলমান ১৪ বছর বাঙালির আপন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন করেছেন, স্বস্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। করোনা, যুদ্ধ, অবরোধ, তেল উৎপাদনকারীদের অমানবিক মুনাফার লোভের কারণে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে জনজীবনে স্বস্তি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে ২০০৮ সালের শিশু-কিশোররা পূর্বের কষ্টের জীবন দেখেনি। আজ তারা সাবালক, তারা ভাষার টান দেখেননি, তাদের সন্তানরাও দেখেনি। জীবনের কমফোর্ট কিছুটা কমার কারণে তাদের মাঝে ঘনীভূত অসন্তোষ দূর করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আশা করছি বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন। অন্য সব রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতা আওয়ামী লীগের রয়েছে।