তিন সিটিতে চ্যালেঞ্জের মুখে আওয়ামী লীগ

তিন সিটিতে চ্যালেঞ্জের মুখে আওয়ামী লীগ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ ৫ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে চলছে নানা সমীকরণ । এর মধ্যে রাজশাহী এবং খুলনা সিটি কর্পোরেশনে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে গাজীপুর, সিলেট এবং রবিশাল সিটিতে। ভোরের পাতার বিভাগীয় প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য ও  বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বরিশাল: নির্বাচন যতো ঘনিয়ে আসছে, ততই উৎকণ্ঠা বাড়ছে বরিশাল সিটির ভোটারদের মাঝে। চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নির্বাচনে বিএনপি না থাকায় ভোটারদের কাছে টানতে নানা কৌশল করছেন লাঙ্গল ও হাত পাখার প্রার্থীরা। তবে বিএনপির ভোট নৌকায় চলে আসবে বলে মনে করে আওয়ামী লীগ। বরিশাল মহানগরে আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি সামনে আসায় নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি হয়েছে। আসন্ন বরিশাল সিটি নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভক্তি স্পষ্ট হয়েছে।
এই বিভক্তি আরও স্পষ্ট হয়েছে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচনী প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে। নির্বাচনী প্রচারণা কমিটিতে বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীদের কাউকে রাখা হয়নি বলে জানা গেছে।
এদিকে আগামী ১২ জুন অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সিটি নির্বাচনে নেই বিএনপি। তবে দলটির সাবেক নেতা কামরুল আহসান রুপন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছেন। এ অবস্থায় মেয়র পদে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী দলের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করিমের অবস্থান আরও শক্ত করতে জোরেশোরে প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি।
গত পহেলা মে বরিশালে আওয়ামী লীগের পক্ষে দুটি পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নেওয়া হয়। এ নিয়ে উত্তেজনাও তৈরি হয় বর্তমান সিটি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারী ও তার বিরোধী পক্ষের মধ্যে। সেদিন সদর রোডে দলীয় কার্যালয়ের সামনে দুই গ্রুপের সভা আহ্বানকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা তৈরি হলে নগরীর বিবির পুকুর ও আওয়ামী লীগ অফিস ঘিরে র‌্যাব ও পুলিশ টহল দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখে। মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকনের পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হলেও, এতে মহানগর আওয়ামী লীগের সব পক্ষের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার কথাও স্বীকার করেছেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীরা জানান, তাদের নেতারা একটি যৌথসভা করবেন। সভা থেকে দিক-নির্দেশনা পেলেই তারা সবাই মিলে সে অনুযায়ী কাজ করবেন। কিন্তু মেয়রপন্থী কাউকে না রেখেই যে নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনা কমিটি করা হয়েছে, ওই কমিটি ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে।
সাদিকপন্থী বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক গাজী নইমুল হোসেন লিটু জানান, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির যৌথ সভায় বরিশাল সিটি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট এ কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘যৌথসভায় আমরা সিদ্ধান্ত নেব যে নির্বাচনে আমাদের কী ভূমিকা থাকবে। সে অনুযায়ী নেতাকর্মীদের দিক-নির্দেশনা দেওয়া হবে।’ তবে, কবে এ যৌথসভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে সঠিকভাবে জানাতে পারেননি তিনি।
এ অবস্থায় মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহর অনুসারীরা প্রচারণা শুরু করেছেন। মহানগর যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক শাহিন সিকদার বলেন, ‘যৌথসভার কথা বলে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। আমরা এজন্য নিজেরাই নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করেছি এবং এ কমিটি ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে।’
সিলেট: নির্বাচনের মাস কয়েক আগে থেকেই মনোনয়নকে কেন্দ্র করে সিলেট নগর আওয়ামী লীগ একাধিক ধারাতে বিভক্ত হয়ে পরেছিল। সেটি এখনো অব্যাহত রয়েছে। গত ২২ জানুয়ারি থেকেই সিলেটে আগাম প্রচার শুরুর পর থেকেই আনোয়ারুজ্জামান ও তার সমর্থকরা মনোনয়নের ব্যাপারে দলের ‘সবুজ সংকেত’ পাওয়ার দাবি করতে থাকেন। এ নিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশী একাধিক নেতা ও সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। আনোয়ারুজ্জামান গত দুটি সংসদ নির্বাচনে সিলেট ২ আসন (ওসমানীনগর-বিশ্বনাথ) থেকে মনোনয়নের চেষ্টা করেছিলেন।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর এক নেতা জানান, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিলেট আওয়ামী লীগে কোন্দল চরম পর্যায়ে রয়েছে। নগরের অনেক নেতাই চাচ্ছেন না বাইরের কেউ এসে নির্বাচন করুন।
তার প্রশ্ন, ‘সিলেট-৩ আসনে লন্ডন প্রবাসী হাবিবুর রহমান হাবিব এমপি হয়েছেন। সিলেট ১ আসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীও প্রবাসী ছিলেন। এখন সিটি নির্বাচনেও প্রবাসী তাহলে স্থানীয়দের রাজনীতি করে কী হবে! স্থানীয় নেতাদের ভবিষ্যৎ কী?’
আনোয়ারুজ্জামান নগরে প্রচার শুরুর পর মেয়র প্রার্থী নিয়ে ‘বিভ্রান্তি না ছড়াতে’ নগর আওয়ামী লীগ বিবৃতিও দিয়েছিল। এক পক্ষে আছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদক, মহানগর শাখার সহসভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক, জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জেলা ও মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা।
আরেক দিকে আছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অনেক নেতাকর্মী। এ ‘কোন্দল’ মেটাতে না পারলে নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে শঙ্কিত নগর আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর সেই সদস্য।
সিলেট সিটিতে মেয়র পদে টানা দুটি নির্বাচনে জেতা বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী আবার ভোটে দাঁড়াবেন কি-না, এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে আরও একটি প্রশ্ন সামনে এল। যদি আরিফুল আবার দাঁড়ান, তাকে মোকাবিলায় নৌকা প্রতীক পাওয়া আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী কতটা সফল হবেন?
পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন মিলিয়ে তিনবার জয় পাওয়া প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান পরের দুইবার হোঁচট খান আরিফুলের কাছেই। এর মধ্যে বিশেষ করে ২০১৮ সালের ভোটে দলীয় কোন্দলের বিষয়টি সামনে আসে। কামরান দলের প্রশ্নাতীত সমর্থন পাননি বলে আলোচনা ছিল।
সেই দ্বন্দ্বের বিষয়টি এবারও আছে। প্রকাশ্যেই কয়েক ভাগে বিভক্ত সিলেট আওয়ামী লীগ। আনোয়ারুজ্জামানকে প্রার্থী করার পর দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও অনেক নেতাই তাকে ‘বাইরের মানুষ’ বলছেন। দলকে এক করতে না পারলে ভোটে প্রভাব পড়বে, এমন কথা বলেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতাও।
সবশেষ পাঁচটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘স্বয়ংক্রিয় পছন্দ’ কামরান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২০২০ সালের ১৫ জুন। ফলে এবার নতুন কাউকে বেছে না নেওয়ার উপায় ছিল না।
ক্ষমতাসীন দলে আগ্রহী প্রার্থীর অভাব পড়েনি। পরে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামানকে উপযুক্ত মনে করে দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড। আগামী ২১ জুনের ভোটে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৩ মে। তা বাছাই হবে দুদিন পর।
গাজীপুর: আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত গাজীপুরের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মেয়র জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠ থেকে ছিটকে গেলেও তার মাকে নিয়ে নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী মাঠে থাকলেও বিএনপি নেই। সংগঠনটির নেতাকর্মীরা একেবারে চুপ। বিএনপিহীন ভোটের মাঠে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর জয় সহজ, না কঠিন হবে– এই সমীকরণও মেলাচ্ছে নগরবাসী।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা খান দলীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় আর নির্বাচনী নানা পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করলেও জাহাঙ্গীর ছিলেন একদম নীরব। গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথাও বলেননি তিনি। একটি সূত্র বলছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে থাকার ইঙ্গিত দেওয়ার পর থেকে দলীয় চাপে রয়েছেন বলেই হয়তো তিনি চুপসে গেছেন। আজমত উল্লা খান দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও নগরের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন টেলিফোনে। তবে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তাঁর কথা হয়নি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠজন।
জাহাঙ্গীর আলমের পাশাপাশি নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছেন ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মামুন ম-ল। তিনি বলেন, নির্বাচিত ও ভারপ্রাপ্ত মেয়রের লুটপাট দেখেছে নগরবাসী। নগরের ভোটার ও জনগণের পূর্ণ সমর্থন নিয়েই আমি নির্বাচনের মাঠে নেমেছি। তারা চায় উন্নয়ন, আমি উন্নয়ন করব। মিথ্যা আশ্বাস দিতে পারি না। দিই না কখনও।’
এদিকে, সিটি নির্বাচন নিয়ে বিএনপির তোড়জোড় না থাকলেও দলটির নেতা সাবেক সংসদ সদস্য হাসান উদ্দিন সরকার প্রস্তুতি নিয়ে রাখছেন নীরবে। কেন্দ্র থেকে নির্দেশ পেলেই তিনি দলবল নিয়ে নেমে পড়বেন নির্বাচনের মাঠে। হাসান সরকার বলেন, ‘নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে এখনও কোনো সংকেত পাইনি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এ নির্বাচনে অংশ নেব না।’
অন্যদিকে, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার আসামি কারাবন্দি নুরুল ইসলাম সরকারের ছেলে সরকার শাহ নুর ইসলাম রনী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের মাঠে আছেন। টঙ্গীর ভোটারদের পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর রনীর প্রতি সমর্থন রয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচনে অংশ না নিলে রনী সরকারই হবেন আজমত উল্লা খানের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী– এমনই গুঞ্জন চলছে নগরজুড়ে। গাজীপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি এম এম নিয়াজ উদ্দিন ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমানও নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন জানান, দল তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনি জয়ী হবেন বলে আশাবাদী।
সিটি নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খান জয়ী হবেন বলে আশা করছেন তাঁর কর্মী-সমর্থকরা। কেউ কেউ বলছেন, জাহাঙ্গীর শেষ পর্যন্ত  তার মাকে নিয়ে মাঠে থাকলে নৌকার জয় কঠিন হবে। আজমত উল্লা খান বলেন, ‘যাঁরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি, আমি তাঁদের সঙ্গেও কথা বলব; আমার দলের নেতৃত্বের সঙ্গেও কথা বলব। আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব যদি বিশ্বাস করেন, তাহলে দলের যে কোনো সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিতে হবে।’
খুলনা ও রাজশাহীতে সুবিধাজনক অবস্থানে আওয়ামী লীগ: ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ৫ সিটির অগ্নি পরীক্ষায় সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। দলের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে পরীক্ষিত ও বর্তমান দুই মেয়রের উন্নয়নে বড় জয় দেখছে দলটি। খুলনায় সিটি ভোটকে কেন্দ্র করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দলে ঐক্য ধরে রেখে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে নির্বাচনে যেতে চায় দলটি। এ কারণে খুলনা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেককে চতুর্থবারের মতো দলীয় মনোনয়ন দিয়ে মাঠে নামানো হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তাকে ঘিরেই ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। খালেককে সামনে রেখেই একইসঙ্গে সংসদ নির্বাচনের মাঠ গোছানো ও দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার দুই টার্গেট নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সংসদ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ খুলনা-২ ও খুলনা-৩ আসন রয়েছে সিটি করপোরেশন এলাকায়। সিটি নির্বাচনে বড় জয় পেলে এর প্রভাব সংসদ নির্বাচনেও পড়বে।
খুলনা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, এবারের সিটি নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ‘অ্যাসিড টেস্ট’। এ নির্বাচনে বিজয় পেলে জাতীয় নির্বাচনও অনেক সহজ হবে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে জয়লাভের পূর্বশর্ত সংগঠনকে শক্তিশালী করা। সংগঠন শক্তিশালী হলে কোনো অপশক্তি ধারের কাছে আসতে পারবে না। আমরা সংগঠন গোছানোর কাজ করে যাচ্ছি।
তালুকদার আবদুল খালেক খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান মেয়র। এর আগে ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে তাকে প্রথম মেয়রপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সেবার তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। তবে ২০১৩ সালের নির্বাচনে তিনি জিততে পারেননি। ওই সময় বিএনপির মেয়রপ্রার্থী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে আবার হারানো পদ ফিরে পান তিনি।
খালেক বলেন, আমি চাই নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বদ্বী থাকুক। বিএনপির নির্বাচনে আসা উচিত। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এই শহরের গুরুত্ব কয়েকগুণ বেড়েছে। তৃতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হয়ে অসমাপ্ত কাজ শেষ করে শহরকে তিলোত্তমা নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।
খুলনা নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানা বলেন, খুলনার উন্নয়নে তালুকদার আবদুল খালেকের বিকল্প নেই। তার গ্রহণযোগ্যতা, দক্ষতা, জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে পর পর দুটি নির্বাচনেই সুফল ঘরে তুলতে চায় আওয়ামী লীগ। আমরা খুলনার উন্ন্নয়নে সিটি নির্বাচনের পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনেও নৌকা প্রতীকে নগরবাসীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
খুলনা সিটি নির্বাচন পরিচালনায় নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও খুলনা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি কাজী আমিনুল হককে আহ্বায়ক এবং নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম ডি এ বাবুল রানাকে সদস্যসচিব করে কমিটি গঠন হয়েছে। দলের বিভিন্ন শাখা ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং আহ্বায়ক -সদস্য সচিবকে সদস্য করা হয়েছে।
এছাড়া নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শহিদুল হক মিন্টুকে খুলনা-২ আসন এলাকার এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলামকে খুলনা-৩ আসন এলাকার সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গত বুধবার রাতে দলীয় কার্যালয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে নগরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বলছেন, এবার আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় মেয়র পদ নিয়ে তাপ-উত্তাপ নেই ভোটারদের মধ্যে। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় আওয়ামী লীগও অনেকটা গা-ছাড়া ভাবে।
এছাড়া গত পাঁচ বছরে খুলনার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ অনেকটা এগিয়ে আছে। এ কারণে জয় অনেকটা নিশ্চিত মনে করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী মাঠে গা-ছাড়া ভাবে রয়েছে।
খুলনা বিএনপি নেতারা জানান, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত খুলনা সিটি করপোরেশনে ৫টি নির্বাচন হয়েছে। এরমধ্যে মেয়রপদে ৩ বার বিএনপি ও দুইবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। আগামী ১২ জুন খুলনা সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে, আসন্ন ২১ জুন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটনকে সমর্থন দিয়ে তাঁকে বিজয়ী করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল।
সম্প্রতি রাণীবাজারস্থ আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১৪ দল রাজশাহীর সমন্বয় সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া সভায় আওয়ামী লীগের মনোনীত ও ১৪ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী জননেতা এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটনের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ও উপ-কমিটি গঠনের বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
১৪ দল রাজশাহীর সমন্বয়ক, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য বেগম আখতার জাহান, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল, জাসদ রাজশাহী মহানগর সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ শিবলী, সাধারণ সম্পাদক আমিরুল কবির বাবু, মহানগর ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ প্রামাণিক দেবু, মহানগর নাপের সভাপতি মোঃ সাইদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক বাসেত হোসেন প্রামিণিক, সাম্যবাদী দলের  সম্পাদক এসএম ওমর ফারুক, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নওশের আলী, অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা, সৈয়দ শাহাদত হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক হোসেন, আহসানুল হক পিন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাড. আসলাম সরকার, আজিজুল আলম বেন্টু, আইন সম্পাদক এ্যাড. মুসাব্বিরুল ইসলাম, প্রচার সম্পাদক দিলীপ কুমার ঘোষ প্রমুখ।
সমন্বয় সভা শেষে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, আমরা ১৪ দল জোটগতভাবে আন্দোলন করেছি, সরকার গঠন করে এখন পর্যন্ত জোটগতভাবেই আছি। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ১৪ দলগতভাবেই আমরা মোকাবেলা করতে চাই। যারা প্রার্থী হবেন, তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই নির্বাচনে আমরা জয়লাভ করতে চাই। শুধু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নয়, এরপরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনও আমরা জোটগতভাবেই করবো ইনশাল্লাহ।
এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূল হবে না।’ আমরা দেখাতে চাই নির্বাচনে প্রচুর পরিমানে মানুষ ভোট প্রদান করবে, শতভাগ স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে ইনশাল্লাহ।
খায়রুজ্জামান লিটন আরো বলেন, আমরা জানি না বিএনপি প্রার্থী দিবে কি দিবে না। তারা এবারো অতীতের মতো কুটকৌশল প্রয়োগ করতে পারে। সেটির বিষয়ে সতর্ক থেকে আমরা নির্বাচনে জয়ী হতে চাই।
রাসিক মেয়র আরো বলেন, রাজশাহীর যে উন্নয়ন করেছি, সেটি দেখে মানুষের দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকার কথা না। তারপরও যারা উন্নয়ন দেখেও চোখ বন্ধ করে রাখেন, সে রকম গোষ্ঠী থাকতে পারে, তাদের কথা ভিন্ন। তবে অধিকাংশ মানুষই নিশ্চয় উন্নয়ন চায়, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা চায়। সেটি আমাদের সরকার নিশ্চিত করছে, আমরা রাজশাহীতে সেটি নিশ্চিত করতে পেরেছি।  বাকিটুকু আগামীতে নিশ্চিত করতে চাই।
লিটন আরো বলেন, নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি মূল কমিটি ও কতগুলো উপ-কমিটি গঠন করা হবে। সে ব্যাপারেও ১৪ দলের সভায় আলোচনা হয়েছে। আগামী ১০ মে পুর্নাঙ্গ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভা আহ্বান করেছি। এরআগেও আমরা বসবো। আমাদের এই বসাটা অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সাংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, মেয়র মহোদয় বলছেন, আগামীতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে কলকারখানাগুলো চালু করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমরা একসাথে কাজ করবো।
বাদশা আরো বলেন, আওয়ামী লীগ কর্তৃক মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে আমরা কাজ করবো। ১৪ দলের কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত আছে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল সে সমস্ত প্রার্থী ঠিক করবে, তাদেরকে আমরা ১৪দল ঐক্যবদ্ধভাবে সমর্থন করবো।
তিনি আরো বলেন, নির্বাচন জনগণের অংশগ্রহণমূলক ও অর্থবহ করার জন্য এটি আমাদের রাজনৈতিক লড়াই। আমরা লড়াই করে মেয়র প্রার্থী ও কাউন্সিলর প্রার্থীকে বিজয়ী করবো। পাশাপাশি বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়-এই ধারণা আমরা মুছে ফেলতে চাই।
জাতীয় রাজনীতি