দেশে জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি বাড়ছে। স্থানীয় গ্যাস এবং আমদানিকৃত এলএনজি স্বল্পতার কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন কমেছে। কয়লা সংকটে পায়রায় চালু থাকা সবচেয়ে বড় কেন্দ্রের দুইটি ইউনিটের একটি বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরেকটিতে সক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদিত হচ্ছে। আগামী জুনের প্রায় পুরোটা কেন্দ্রটি সম্পূর্ণ বন্ধ থাকার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না রামপাল কেন্দ্রও। দাম বেশি হওয়ার কারণে পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো।
দৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
পেট্রোবাংলা এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছেন, অপ্রতুল স্থানীয় জ্বালানি, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি এবং অর্থ-ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি আমদানিতে ঘাটতি এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে দৈনিক প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে। চলতি মাসে এটি ২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। ঘাটতি আরও বাড়তে পারে। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি এবং দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন সম্প্রতি বৃদ্ধি না পেলে সংকট আরও গভীর হতে পারতো বলে মনে করছেন তারা। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাবদ বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ১৮ হাজার কোটি টাকার বিল বকেয়া পড়ে রয়েছে। সরকার এ বকেয়া শিগগিরই কমিয়ে না আনলে কয়েকটি কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে কয়েকটিতে উৎপাদন কমে এসেছে।
গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি এবং বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে অধিকাংশ শিল্পে উৎপাদন কমে গেছে বলে জানিয়েছেন একাধিক শিল্পমালিক ও উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, অনেক সম্ভাবনা থাকলেও কারখানার চাকা গতিশীল রাখতে না পারায় ব্যবসা গুটিয়ে বা আকার কমিয়ে আনছেন অনেক উদ্যোক্তা। মেশিন বন্ধ এবং কারিগরি সীমাবদ্ধতার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আর গরম ও তাপদাহের মধ্যে বিদ্যুতের ঘনঘন যাওয়া-আসার কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে শহর-গ্রামের জনজীবন। শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষের কষ্ট বেড়েছে। বিদ্যুতের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও ফ্যানসহ নানা ইলেক্ট্রনিক পণ্য নষ্ট হওয়ার ঘটনাও বেড়েছে বলে ইত্তেফাকের কয়েকটি জেলার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। তারা জানান, এলাকাভেদে দিনে চার থেকে ১০ বার বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে বা সরবরাহ বন্ধ থাকছে। কিন্তু অনেক সময় মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ আসে এবং চলে যায়। এতে ইলেক্ট্রিক ও ইলেক্ট্রনিক পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উল্লেখ্য দেশে বর্তমানে আমদানিসহ দৈনিক ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে কেন্দ্রগুলোর। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। এ সময়ে দৈনিক গড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি চাহিদা রয়েছে। গত রবিবার পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ১৩৬ মেগাওয়াট এবং অফ পিকে ১১ হাজার ৭৮৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে।
ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস এসোসিয়েশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গতকাল বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে সরকারের প্রচেষ্টা ও চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালন সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু জ্বালানিতে ঘাটতি রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন, সাশ্রয়ী এবং টেকসই বিদ্যুৎ দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ চলছে। তিনি বলেন, করোনার সময়ে বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাস-কয়লার দাম কমলেও তখন দেশে চাহিদা কমে যায়। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর দেশে চাহিদা বাড়লেও বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তবে বুয়েটের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বিশ্ববাজারে এখন তেল-কয়লা-এলএনজির দাম কমে গেছে। খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানির খরচ চুক্তিকৃত মূল্যের চেয়েও কম পড়বে। তাই শুধু দামের কারণে এ সংকট এখন থাকা উচিত না।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের প্রাক্তন সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মকবুল ই এলাহী চৌধুরী বলেন, যতদিন পর্যন্ত উৎস জ্বালানির সমস্যা শেষ না হবে ততদিন বিদ্যুতের সংকট কাটবে না। তাই জ্বালানিতে আরো গুরুত্ব দিতে হবে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ডিসিসিআই’র সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার বলেন, দেশের বেসরকারিখাতের উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নে একটি পূর্ব অনুমানযোগ্য জ্বালানির মূল্য নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে জ্বালানি চাহিদা এবং সরবরাহের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা আবার সংশোধন করা দরকার।