দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের পাশাপাশি রয়েছে করোনা-পরবর্তী যুদ্ধ পরিস্থিতিতে টালমাটাল বিশ্বঅর্থনীতির প্রভাব। এমন পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে বৈদেশিক ঋণের বিকল্প দেখছে না সরকার। তাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনেই নতুন অর্থবছরের বাজেট তৈরি হয়েছে। জাতীয় সংসদে আজ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যা প্রস্তাবিত বাজেট হিসেবে দীর্ঘ আলোচনার পর আগামী ২৫ জুন পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেটি কার্যকর হবে আগামী ১ জুলাই থেকে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রের তথ্যমতে, নতুন অর্থবছরের জন্য আজ সংসদে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করবেন, তার আকার হবে সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এটি চলতি সংশোধিত বাজেটের চেয়ে এক লাখ এক হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। মেগা এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এটি অর্জন করতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ৬৭ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করতে হবে। এবার ঘাটতি বাজেট (অনুদানসহ) হবে দুই লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এটি নতুন অর্থবছরের জিডিপির পাঁচ দশমিক দুই শতাংশের ঘরে রাখা হয়েছে। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ হবে দুই লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। চলতি বাজেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামী বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ। তবে মূল্যস্ফীতির হার পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে এক শতাংশ বাড়িয়ে ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশ ধরা হচ্ছে। তথ্যমতে, আগামী বাজেটে মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে কর আদায় করা হবে চার লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ অঙ্ক চলতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। এনবিআরের মাধ্যমে কর আসবে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৬০ হাজার কোটি বা ১৬ শতাংশ বেশি। আর এনবিআর-বহির্ভূত কর থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ২০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর ছাড়া রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এ অঙ্ক ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এদিকে আয় পর্যাপ্ত না থাকায় আগামী অর্থবছরে ব্যয়ের আকার বাস্তবতার নিরিখে বাড়ানো যায়নি বলে জানান অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এরপরও আসন্ন বাজেটে চূড়ান্ত ব্যয়ের মধ্যে সরকারের পরিচালন খাতে ধরা হয়েছে চার লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে আবর্তক ব্যয় হবে চার লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি এবং মূলধনি ব্যয় ৩৯ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ব্যয় হবে দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাজেটের আকার অনেক বেড়েছে। কিন্তু তা জিডিপির ১৫ শতাংশের আশেপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থায় একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বাজেটের আকার জিডিপির ২৫-৩০ শতাংশের মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়। সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা ও উন্নয়ন কার্যক্রম চালু রাখতে হলে সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। পরনির্ভশীলতা ত্যাগ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের বিকল্প নেই। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী জিডিপির অনুপাতে ঘাটতি বাজেট কমানো হয়েছে। এই ঘাটতি বাজেট পূরণে দুটি খাত থেকে ঋণ করতে হয়। প্রথম হচ্ছে বৈদেশিক ঋণ এবং দ্বিতীয় অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ। আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে এক লাখ দুই হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৮৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এছাড়া অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নেয়া হচ্ছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ব্যাংক খাত থেকে নেয়া হবে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ২৩ হাজার কোটি, সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার কোটি ও অন্যান্য খাত থেকে আরও পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার।
যেসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে : বাজেটে করহার ব্যাপকভাবে বাড়ানো হচ্ছে। একইসঙ্গে নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী, যেমন : প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, টয়লেট টিস্যু, কলম, মোবাইল ফোন উৎপাদনে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া ডলার সাশ্রয়ে এবং শুল্ক ফাঁকি রোধে কাজুবাদাম, খেজুরের মতো খাদ্যসামগ্রীর আমদানি শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ এ বাজেট জীবনযাত্রার খরচ বাড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এনবিআরের সক্ষমতা বিবেচনায় আগামী বাজেটে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী বলে মনে হয়। এ লক্ষ্যের ধারেকাছেও এনবিআর যেতে পারবে না। কারণ এখনো সংস্থাটিতে গুণগত পরিবর্তন আনা হয়নি। তিনি আরও বলেন, রাজস্বের লক্ষ্য পূরণে এনবিআর সব সময় সহজে কর আদায়ের (ইজি ট্যাক্স কালেকশন) পন্থা অবলম্বন করে। অথচ পণ্যের ভ্যাট বাড়ালে স্বভাবতই জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। সে অনুপাতে করজাল বৃদ্ধিতে এনবিআরের তেমন নজর লক্ষ করা যায় না।
জানা গেছে, গৃহস্থালি সামগ্রীর ক্ষেত্রে বাসাবাড়িতে ব্যবহূত প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালি সামগ্রী উৎপাদনে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে সাত দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। একই হারে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী ও তৈজসপত্রে (হাঁড়িপাতিল, থালাবাসন) ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু/পকেট টিস্যু ও পেপার টাওয়াল উৎপাদনে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে সাত দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে টিস্যু পেপারের দাম বাড়তে পারে।
শুল্ক ফাঁকি রোধে বাজেটে সব ধরনের ওভেন আমদানির শুল্ক ৩০ শতাংশ বাড়াচ্ছে, মোট করভার ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বিদেশি ওভেনের দাম বাড়তে পারে। এছাড়া সিলিন্ডার উৎপাদনে ব্যবহূত স্টিল ও ওয়েল্ডিং ওয়্যার আমদানিতে শুল্কারোপ এবং উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। এতে বাজারে সিলিন্ডারের দাম বাড়তে পারে। বিরিয়ানি-তেহারির প্রধান উপকরণ বাসমতি চাল আমদানিতে ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এতে চালের দাম বাড়তে পারে। বাজেটে তাজা ও শুকনো খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। দেশে বাদাম চাষকে উৎসাহিত করতে কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৩ শতাংশ করা হচ্ছে। তাই আমদানি করা কাজুবাদামের দাম বাড়তে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফল ও বাদামের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে বিধায় ফল ও বাদামের দাম বাড়তে পারে।
বাজেটে সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়ানো হচ্ছে। নিম্নস্তরের এক প্যাকেট (২০ শলাকার) সিগারেটের (হলিউড, ডার্বি) দাম ৯০ টাকা, মধ্যমস্তরের (স্টার, নেভি) ১৩৪, উচ্চস্তরের (গোল্ডলিফ) ২২৬ এবং অতি উচ্চস্তরের (বেনসন, মালবোরো) সিগারেটের দাম ৩০০ টাকা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ানো হচ্ছে জর্দা-গুলের দামও। তবে বিড়ির দাম অপরিবর্তিত থাকবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে আইএমএফের পরামর্শে মোবাইল ফোনকে বিলাসী পণ্য বিবেচনায় নিয়ে বাজেটে ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে মোবাইল ফোন উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি আছে, সেখানে দুই শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। আর সংযোজন পর্যায়ে তিন শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ এবং পাঁচ শতাংশ থেকে সাত দশমিক ৫০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। এ কারণে খুচরা পর্যায়ে মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে। এছাড়া কলম উৎপাদনে বর্তমানে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে, সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এতে কলমের দাম বাড়তে পারে। চশমার ফ্রেম ও সানগ্লাস আমদানিতে শুল্ক পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এছাড়া উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে সাত শতাংশ করা হচ্ছে। সাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। সিরিশ কাগজ আমদানিতেও শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। ভাঙা জিনিস জোড়া দেয়ার আঠা বা গ্লু সংরক্ষণমূলক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। বাজেটে বাড়ি নির্মাণের প্রধান উপকরণ সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে বর্তমানে টনপ্রতি ৫০০ টাকা শুল্ক আছে, এটি বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হচ্ছে। এ কারণে সিমেন্টের দাম বাড়তে পারে। বাসাবাড়িতে ব্যবহূত বিদেশি টাইলস আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এ কারণে বিদেশি টাইলসের দাম বাড়তে পারে। অবশ্য কমার তালিকা একেবারেই ছোট। মিষ্টির দাম কমতে পারে। কারণ, মিষ্টির ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে সাত শতাংশ করা হচ্ছে। এছাড়া আরও কিছু পণ্যের ভ্যাট কমানো হচ্ছে।
নিম্ন আয়ের মানুষকে করজালের মধ্যে আনার ছক : শূন্য আয় (করযোগ্য সীমার নিচে বার্ষিক আয়) দেখিয়ে আগে রিটার্ন জমা দেয়া গেলেও আগামী দিনে স্লিপ (প্রাপ্তিস্বীকারপত্র) পেতে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। আর রিটার্ন জমার স্লিপ না নিলে সঞ্চয়পত্র কেনা এবং ব্যাংক ঋণ নেয়া যাবে না। ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস নবায়ন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ, বাড়ির নকশা অনুমোদনসহ সব মিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি ৪৪ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে না।