করযোগ্য আয় না থাকলেও বাজেটে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর আরোপের প্রস্তাব নিয়ে কয়েক দিন বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অনেকে বলছেন, যার করযোগ্য আয় নেই, তার কাছ থেকে কর নেওয়া অন্যায্য। এর জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছেন, যাদের ওপর এ কর ধার্য হবে, তাদের দেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে। যাদের বাধ্যতামূলক টিআইএন নিতে হয়, তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ২ হাজার টাকা দেওয়া গর্বের বিষয় হতে পারে। এখন দেখা যাক কাদের আসলে এই ২ হাজার টাকা দিতে হবে।
অর্থ বিল এবং অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে যা আছে
সংসদে উপস্থাপিত অর্থ বিল ২০২৩-এ বলা হয়েছে, আয়কর অধ্যাদেশের ৭৫ ধারা অনুযায়ী রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এমন করদাতার মোট আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম না করলে আয়ের পরিমাণ নির্বিশেষ ন্যূনতম করের পরিমাণ ২ হাজার টাকা হবে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে অবশ্য বলা হয়েছে, সরকারি সেবা নিতে যাদের রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধ্যকতা আছে, তাদের এই কর দিতে হবে। রাষ্ট্র থেকে পাওয়া সুযোগ-সুবিধার বিপরীতে সরকারকে ন্যূনতম কর দিয়ে জনসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তিনি এ প্রস্তাব করেছেন। অর্থ বিল এবং মন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। কেননা, শুধু কিছু সেবা নিতেই রিটার্ন দাখিলের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে, এমন নয়। সেবা নেওয়ার বাইরেও কিছু ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিল করতে হয়।
কারা রিটার্ন দাখিলে বাধ্য
আয়কর আইন অনুযায়ী, যেসব ব্যক্তির আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করবে, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। বার্ষিক আয় করমুক্ত সীমার নিচে থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। দেখা গেছে, এ রকম ১৯টি ক্ষেত্রে যাদের আবশ্যিকভাবে রিটার্ন দিতে হয়, তাদের অনেকরই আয় করমুক্ত আয়ের সীমার ওপরে, অর্থাৎ তারা স্বাভাবিক করদাতা।
১৯টি ক্ষেত্র
আয়বর্ষের পূর্ববর্তী তিন বছরের যে কোনো বছর করদাতার কর নির্ধারণ বা তার আয় করযোগ্য হয়ে থাকলে। কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হলে। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক বা কর্মচারী হলে। সরকারি বা সরকারি কর্তৃপক্ষ বা করপোরেশনের বা আইন দ্বারা গঠিত কোনে সত্তার কর্মচারী হয়ে ১৬ হাজার টাকা বা তার বেশি মূল বেতন পেলে। কোনো ব্যবসায় বা পেশায় নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পদে বেতনভোগী কর্মী হলে। কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত বা হ্রাসকৃত হারে করযোগ্য আয় থাকলে। মোটর গাড়ির মালিক হলে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা বা কোনো পেশা পরিচালনা করলে। ভ্যাট আইনের অধীনে নিবন্ধিত কোনো ক্লাবের সদস্য পদ থাকলে। চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার ও সমজাতীয় পেশাজীবী হিসেবে কোনো স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থায় নিবন্ধিত হলে। আয়কর পেশাজীবী হিসেবে এনবিআরে নিবন্ধিত হলে। কোনো বণিক বা শিল্পবিষয়ক চেম্বার, ব্যবসায়িক সংগঠন বা সংস্থার সদস্য হলে বা কোনো পৌরসভা, সিটি করপোরেশনের কোনো পদে বা সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী হলে। সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, স্থানীয় সরকারের কোনো টেন্ডারে অংশ নিলে। কোনো কোম্পানি, গ্রুপ অব কোম্পানিজের পরিচালক হলে। মোটরযান, জায়গা, বাসস্থান বা অন্যান্য সম্পদ সরবরাহ করে কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিলে। লাইসেন্সধারী অস্ত্রের মালিক হলে।
যেসব সেবায় রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ লাগে
গত বছর সরকারি বা বেসরকারি কিছু সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ উপস্থাপন করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এগুলো পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা হলো। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণ নিলে। ক্রেডিট কার্ড পেতে ও বহাল রাখতে। ১০ লাখ টাকার বেশি ক্রেডিট ব্যালান্সসহ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে ও বহাল রাখতে। পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে এবং পোস্ট অফিস সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট খুলতে। আমদানি-রপ্তানির নিবন্ধন সনদ নিতে বা বহাল রাখতে। আমদানির উদ্দেশ্যে ঋণপত্র খুলতে। সমবায় সমিতির নিবন্ধন নিতে। সিটি করপোরেশন, জেলা শহরের পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এলাকায় ১০ লক্ষাধিক টাকার জমি, ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রয়, হস্তান্তর, বায়না বা আমমোক্তারনামা নিবন্ধন করতে। নিকাহ্ রেজিস্ট্রার হিসেবে লাইসেন্স পেতে ও বহাল রাখতে। ড্রাগ, ফায়ার, বিএসটিআই লাইসেন্স এবং পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে ও নবায়নে। যে কোনো এলাকায় বাণিজ্যিক গ্যাস এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় আবাসিক গ্যাসের সংযোগ নিতে। সিটি করপোরেশন, জেলা সদর বা পৌরসভায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিশু বা পোষ্য ভর্তি করতে, এমপিওভুক্তির মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে মাসিক ১৬ হাজার টাকার বেশি অর্থ পেতে।
দ্বিচক্র বা ত্রিচক্র মোটরযান ব্যতীত অন্যান্য মোটরযানের নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়ন করলে। বীমা কোম্পানির এজেন্সি সার্টিফিকেট নিবন্ধন বা নবায়নে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পণ্য বা সেবা বিক্রয়ে, পণ্য আমদানি বা রপ্তানির উদ্দেশ্যে বিল অব এন্ট্রি দাখিল কালে। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভায় ভবন নির্মাণের নকশা দাখিল কালে। পণ্য বা সেবা সরবরাহের জন্য টেন্ডার ডকুমেন্টস দাখিল কালে। কোম্পানি আইন এবং সোসাইটি নিবন্ধন আইনে নিবন্ধিত ক্লাবের সদস্য পদ পেতে এবং এনজিও বা ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থায় বিদেশি ঋণ ছাড়ে।