দৃষ্টি এখন জাতীয় নির্বাচনে। ছয় মাস আগেই চাপা উত্তেজনা। কূটনৈতিক দরবারে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমপি-মন্ত্রী ও সুশীল সমাজের দৌড়ঝাঁপ। আন্তর্জাতিক নানা হস্তক্ষেপে সংলাপের পক্ষে-বিপক্ষে সমিকরণ চলছে। আওয়ামী লীগ বলছে— সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সরকার গঠন।
বিএনপি বলছে, সংসদ ভেঙে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এমন পরিস্থতিতে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মাঠে নানা প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন কী আদৌ যথাসময়ে হচ্ছে, নাকি ঘটছে অন্য কিছু । সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয়জন সদস্যর চিঠি দেশের রাজনীতিতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। জানা গেছে, গেলো দুই সপ্তাহে রাজনীতিবিদদের নিয়ে কূটনৈতিক মহলের একাধিক বৈঠকে একটি আপস প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কীভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। কূটনীতিকরা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্য থেকে গ্রহণযোগ্য নেতাদের দিয়ে সংঘাত ছাড়া নির্বাচন কার্যক্রমের কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন। আ.লীগ এবং বিএনপির বাইরে দুদলের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে এমন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নাম উপস্থাপন করা হয়েছে। যাকে প্রধান করে দুবছরের জন্য একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে। যিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরে গিয়ে কিছু সময় দেশের অর্থনীতি রাজনীতি ও নানা সংকটের সংস্কার করবেন।
কূটনীতি ও রাজনীতির নির্ভরযোগ্য সূত্র আমার সংবাদকে জানিয়েছেন, জাতীয় সরকারের প্রধান হিসেবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নাম প্রস্তাবিত রয়েছে একটি শক্তিশালী মহল থেকে। আর সেটি আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেই হতে পারে। বিশেষ মহলের প্রস্তাবিত নামের বিষয়ে এখন পর্দার আড়ালে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। রাজনৈতিক ঐকমত্য হলেই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, যিনি জাতীয় সরকারের প্রধান হবেন তিনি আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারবেন না। তিনি ২০-৩০ জন সদস্য নিয়ে একটি সরকার পরিচালনার খসড়া দাঁড় করাবেন। তাদেরকে নিয়ে নির্বাচন পর্যন্ত দেশ পরিচালনায় ফর্মুলা তৈরি করবেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংঘাত ও সহিংসতা এড়িয়ে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করবেন। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করবেন। তবে ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও বিএনপির পক্ষ থেকেও সবুজ সংকেত পাওয়া গেছে। সূত্রের ভাষ্য, বিএনপি মনে করছে, জিএম কাদের জাতীয় সরকারপ্রধান হলে ওই সময়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনসহ নিজেদের মাঠ গোছাতে পারবে। ইতোমধ্যে বিএনপি হরতাল অবরোধ, জ্বালাও পোড়াওয়ের ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে। আর এই নীতিকে বিদেশিরাও ভালোভাবে গ্রহণ করছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে চলছে তারুণ্য সমাবেশ ও মহিলা দলের কর্মসূচি। নির্বাচন পর্যন্ত শান্তনীতিতে এ কর্মসূচি আরো গতি পাবে।
অন্যদিকে আ.লীগ মনে করছে, আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে যে একটি সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে অবশ্যই সরকারের জন্যও ভালো কিছু বয়ে আনবে না। কেউ যদি সরাসরি ক্ষমতায় আসে তাহলে ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীদের বড় অংশের প্রাণনাশের ঝুঁকি রয়েছে। এমন তথ্যও গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আ.লীগ যেমন চায় সহিংসতামুক্ত একটি নির্বাচন; আর দেশের কূটনৈতিক মহলও চায় রক্তপাতমুক্ত একটি নির্বাচন। সরকারকে এখন ছাড় দেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। সমপ্রতি মার্কিন ভিসানীতির পর বাংলাদেশের বিষয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয়জন সদস্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তারা বলেছেন, বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন নিশ্চিতে অবদান রাখতে আপনাকে অনুরোধ করছি এবং জোর দিতে চাই, যা ২০২৩ সালের শেষের দিকে বা ২০২৪ সালের শুরুতে নির্বাচন হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, জনগণের তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার এখনো বাকি। কারণ দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এটি একটা সমস্যা; যেহেতু কারচুপি, কারসাজি এবং ভোটারদের অনুপস্থিতি ১০ ও ১১তম সংসদ নির্বাচনকে বিঘ্নিত করেছে। এ ছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘনে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করারও আহ্বান জানানো হয় ওই চিঠিতে। এ কারণে সরকারের ওপর বহুমুখী চাপ অব্যাহত রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া সমাপ্তির মাধ্যমে আ.লীগ সেই দায় থেকেও মুক্ত হতে চাচ্ছে। ছাড় দেয়ার বিষয়েও মানসিকতা রয়েছে দলের অভ্যন্তরে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সমপ্রতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সৈয়দা রিজওয়ানা চৌধুরী, হোসেন জিল্লুর রহমান, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্যসহ কিছু অভিজ্ঞ বিশেষ ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্যতা বাড়িয়েছেন জিএম কাদের। এ ছাড়া নাগরিক সমাজ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে তিনি ফর্মুলা তৈরি করছেন। দেশের বর্তমান ভঙ্গুর অবস্থা কীভাবে সংস্কার করা যায়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে উদ্ধার এবং দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থা আগের মতো ফিরিয়ে আনা যায়। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও গরিবদের বাঁচার মতো একটি পরিস্থিতি তৈরি যায়। যদি সেই সংস্কার সময়ের দায়িত্ব পাওয়া হয় তাহলে সময়টি দুই বছরের বেশি হবে না বলেও মনে করা হচ্ছে। জাতীয় পার্টির একাধিক সিনিয়র নেতা বলছেন, জিএম কাদের যে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হচ্ছেন তারাও ইঙ্গিত পেয়েছেন। তারা মনে করছেন, জিএম কাদের যদি নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হন তাহলে বড় দুই রাজনৈতিক দলের কারো জন্য ভালো হবে, কারো জন্য ক্ষতি হবে; এমনটি নয়। স্বচ্ছতার বিষয়ে জিএম কাদেরকে বিশ্বাস করা যায়। তার কাছ থেকে আ.লীগও অতিরিক্ত সুবিধা নিতে পারবে না; কিংবা বিএনপিও সেই সুযোগ পাবে না। গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে জিএম কাদের কোনো কিছুতেই আপস করবেন না। তিনি সম্ভাব্য দুবছরের নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের পরবর্তী রাজনীতির ইতিহাসে নিজেকে উপস্থাপন করবেন।
সমপ্রতি এ নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদের জানান, জাতীয় পার্টি দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করছে। জাতীয় সরকার নিয়ে ‘আলাপ-আলোচনার পর পার্টি ফোরাম অ্যাপ্রুভ করলে তবেই বিষয়টি প্রকাশ করবেন, তার আগে নয়। এখন যেখানে সরকার ও বিরোধী দল অনড় অবস্থানে; সেখানে এসব ফর্মুলা দিয়ে কতটুকু লাভ হবে, বলা যাচ্ছে না। সরকার যদি একটি মতামত আহ্বান করে, যদি একসঙ্গে বসে সমাধানের আন্তরিকতা দেখায়, তখন আমরা আমাদের ফর্মুলাটা সেখানে উপস্থাপন করব। একটা খসড়া দাঁড় করিয়েছি, পার্টি ফোরাম অ্যাপ্রুভ করলে তারপর প্রকাশ করব। তবে মোটামুটি যেটি চিন্তা করেছি, সেখানে সরকারকে কিছুটা ছাড় দিতে হবে। বাদবাকি মোটামুটি সব কাঠামোর মধ্যেই থাকবে। তাতে আশা করব যে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, দেশে এখন শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি চলছে। দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। লোকজনের আয়-রোজগার কমে গেছে। ডলার সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব বেড়েছে। রিজার্ভ কমে আমদানিও কমে গেছে। আমাদের দেশের চেয়ে শ্রীলঙ্কাতেও অনেক পণ্যের মূল্য কম। শ্রীলঙ্কার জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ রাস্তায় নামতে পারছে না। দেশে একটি পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে এমন রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে নির্বাচনকালীন ছোট সরকার গঠন হবে। আ.লীগ জনগণের কাছে যে অঙ্গীকার করেছিল, সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে। তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, এই সরকার সরে যেতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন দিতে হবে। সরকার যদি পদত্যাগ করে। তখন আলোচনা করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন, জিএম কাদের যেমন সরকারের ঘরে রয়েছে তেমনি বিএনপির সাথেও সখ্য রয়েছে। গেলো ঈদে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি আয়োজিত ঈদ পুনর্মিলনী ও আড্ডায় বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিকে এক টেবিলে বসে। এর আগে একাধিক ইফতারেও তিনি বিএনপির সঙ্গে বসেন।
এ নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে যে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কী সমঝোতা করছেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে কিছু একটা হচ্ছে তা সবাই উপলব্ধি করছে। সব মিলিয়ে এখন রাজনীতিতে ধোঁয়াশা চলছে। আ.লীগ এবং বিএনপি বড় দুটি দলই এখনো এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে আছে। তারা হয়তো এখনো দেখতে চাইছে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। আ.লীগ যা বলছে বিএনপি তার উত্তর দিচ্ছে। ঈদের পর হয়তো একটা পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে বলে ধারণা করছি। সরকারের অধীনে নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক এ দুইয়ের মধ্যে একটি প্রক্রিয়া দাঁড় হতে পারে, সেটি হতে পারে জাতীয় সরকার। দুদলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এমন প্রক্রিয়া আসতে পারে তা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে আমাদের দেশের নাগরিকের সমাধানের বাইরে বিদেশিদের ছকে কোনো সমঝোতা এটি অবশ্যই আমাদের জন্য লজ্জার।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘সমপ্রতি আমাদের দেশে বিরোধী দলের বক্তব্য অনেকাংশে পশ্চিমা দেশগুলো গ্রহণ করেছে। গণতন্ত্রে