রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১৯টি পশুর হাটে কোরবানির পশুবাহী ট্রাক আসতে শুরু করেছে। হাটগুলো ভরে উঠছে কোরবানির গরু-ছাগলে। বেচাকেনা সেভাবে শুরু না হলেও নগরবাসী ঢুঁ মারছেন পশুর হাটগুলোতে। ঘুরে ফিরে দেখছেন গরু-ছাগল। কেউ কেউ আবার দরদামও জিজ্ঞাসা করছেন। পছন্দ হলে পশুটি কিনেও আনছেন। ফলে নগরীর অলি-গলি ও বাসার সামনে কোরবানির পশু দেখা যাচ্ছে। ফুটপাত দিয়ে ছোট ছোট মৌসুমি বেপারিরা বিক্রির জন্য ছাগলের পাল নিয়ে ছুটছেন। সেখানেও বিক্রি হচ্ছে কোরবানির পশু।
এবার পশুর দাম বেশি বলে জানিয়েছেন হাটে আসা বেপারিরা। তাদের মতে, গরু-ছাগল লালন-পালনে খরচ বেড়ে যাওয়ায় পশুর দাম বেড়েছে। আর যারা কোরবানি দেবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাদের শঙ্কা নিজস্ব ‘বাজেটের’ মধ্যে পাওয়া যাবে তো কাক্সিক্ষত পশুটি! ক্রেতা-বিক্রেতাদের স্বার্থে হাটে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে।
জানা গেছে, ঢাকার হাটগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে বেচাবিক্রি শুরু হবে আগামীকাল ২৫ জুন (রবিবার) থেকে। যদিও ঢাকার স্থায়ী পশুরহাট গাবতলী এবং সারুলিয়ায় ইতোমধ্যে কোরবানির পশু বিক্রি শুরু হয়েছে। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার খামারগুলোতে পুরোদমে চলছে পশু বেচাকেনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রথমবারের মতো ঢাকার প্রতিটি হাটে ‘ক্যাশলেস’ কাউন্টার স্থাপন করবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এতে ভোক্তারা নগদ টাকার পরিবর্তে অনলাইনে গরু-ছাগল কিংবা অন্য পশুর দাম বিক্রেতাকে পরিশোধ করতে পারবেন। তবে করোনা প্রতিরোধে এবারও হাটগুলোতে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছে সিটি করপোরেশন।
ঢাকার পশুর হাটগুলো ঘুরে দেখা গেছে, হাট বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। ‘গরু-ছাগলের বিরাট হাট’ লেখা ব্যানার শোভা পাচ্ছে পশুর হাটের প্রবেশদ্বারে। হাট কর্তৃপক্ষ বাড়তি ক্রেতা ও পশুর বেপারিদের টানতে মাইকিং শুরু করছেন। নগরীর বিভিন্ন স্থানে বানানো হয়েছে বড় বড় গেট, তাতে শোভা পাচ্ছে গরু-ছাগলের ছবি সংবলিত বাহারি পোস্টার।
এছাড়া গরু-ছাগল বেঁধে রাখার জন্য হাটে খুঁটি পোঁতা, বাঁশের বেষ্টনি ও বেড়া নির্মাণ করা হয়েছে। শামিয়ানা টানিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ‘হাসিল’ ঘর। এছাড়া পশুর খাবার রাখার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে চাটাই পাতা হয়েছে হাটগুলোতে। নিরাপত্তার জন্য হাটে হাটে তৈরি করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। এছাড়াও ক্রেতা বিক্রেতাদের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্পও থাকবে হাটে। হাটের মাঝখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক পানির ট্যাঙ্ক, বেসিন, সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখার ব্যবস্থা করেছেন কর্তৃপক্ষ। হাট বসার শুরু থেকে থাকবে ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিম। জাল টাকার ছড়াছড়ি ও ব্যবহার বন্ধে সতর্ক থাকবে পুলিশ। চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি বন্ধে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে।
মেরাদিয়া হাটে খুঁটি পুঁতছিলেন জহির উদ্দিন। তিনি জানান, গত কয়েকদিন আগে থেকে হাট বসানোর কাজ শুরু করা হয়েছে। এখন কাজ প্রায় শেষের দিকে। যে কেউ গরু-ছাগল হাটে এনে বেঁধে রাখতে পারবেন। ইতোমধ্যে হাটে গরু-ছাগল আসতে শুরু করেছে।
আর্থিকভাবে সচ্ছল শৌখিন নগরবাসী একটু আগে-ভাগে কোরবানির পশু কিনে কিনছেন গাবতলী থেকে। এ কারণে গাবতলীর পশুর হাট এখন জমজমাট। অন্যদিকে সারুলিয়া হাটেও কোরবানির পশু আসতে শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. রাসেল সাবরিন জনকণ্ঠকে বলেন, অস্থায়ী হাটগুলোতে শুক্রবার থেকে পশু আসতে শুরু করেছে। এছাড়া স্থায়ী হাটগুলোতে পশু আসছে এবং মোটামুটি বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। নগরবাসীর সুবিধার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবার কোরবানির দিনসহ মোট পাঁচদিন ঢাকার অস্থায়ী হাটগুলোতে পশু বেচাকেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ওই হিসেবে ২৫ জুন থেকে পুরোদমে কোরবানির পশু বিক্রি শুরু হবে ঢাকায়। তিনি জানান, স্বাচ্ছন্দ্যে কোরবানির পশু যাতে কেনাবেচা হয়, সে লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এছাড়া এবার নগদ টাকার পরিবর্তে অনলাইনে পশুর দাম পরিশোধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এজন্য ক্যাশলেস কাউন্টার করা হবে প্রতিটি হাটে।
তিনি আরও জানান, করোনা প্রতিরোধে সর্দিকাশি, জ্বর বা শ্বাসকষ্ট নিয়ে কেউ হাটে প্রবেশ করতে পারবেন না। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের নির্দেশনা রয়েছে।
যেসব স্থানে পশুর হাট ॥ ঢাকায় এবার ১৯টি পশুর হাটে হবে কোরবানির পশু কেনাবেচা। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় নয়টি আর ১০টি বসবে ঢাকা উত্তরে। এর মধ্যে গাবতলী ও সারুলিয়ার হাট স্থায়ী। ডিএসসিসি এলাকায় হাটগুলো হলো- মেরাদিয়া বাজার সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, দনিয়া কলেজ মাঠসংলগ্ন খালি জায়গা, ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল সংলগ্ন উন্মুক্ত জায়গা, হাজারীবাগ এলাকায় ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি মাঠসংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকা, আমুলিয়া মডেল টাউনের আশপাশের খালি জায়গা, লালবাগের রহমতগঞ্জ ক্লাবসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাবসংলগ্ন খালি জায়গা, কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন বিশ্বরোডের আশপাশের এলাকা, খিলগাঁও শাজাহানপুর রেলওয়ে কোয়ার্টার মাঠ এবং পোস্তগোলা শ্মশান ঘাটসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা। ঢাকার শাজাহানপুর ও কমলাপুর হাটে পশুবাহী ট্রাক আসতে শুরু করেছে।
কমলাপুর হাটে পাবনা থেকে এক ট্রাক গরু নিয়ে এসেছেন সালাম শিকদার। তিনি জানান, কোরবানির জন্য তিনি বিভিন্ন খামার থেকে ৩০টি গরু কিনেছেন। ইতোমধ্যে ঢাকার এই হাটে এক ট্রাক আনা হয়েছে। বাকি গরুগুলো অন্যান্য হাটে তোলা হবে। তিনি জানান, এবার দাম একটু বেশি হবে।
ডিএনসিসির অধীন হাটগুলো হলো- গাবতলী (স্থায়ী), বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিং (ব্লক-ই, এফ, জি, এইচ) এলাকার খালি জায়গা, মিরপুর সেকশন-৬ ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গা, উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর এলাকায় অবস্থিত বৃন্দাবন থেকে উত্তর দিকে বিজিএমইএ পর্যন্ত খালি জায়গা, ভাটারা (সাইদনগর) পশুর হাট, কাওলা শিয়ালডাঙ্গাসংলগ্ন খালি জায়গা, ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৩০০ ফিট সড়কসংলগ্ন উত্তর পাশের সালাম স্টিল ও যমুনা হাউজিং কোম্পানির এবং ব্যক্তিগত মালিকানাধীনের খালি জায়গা এবং মোহাম্মদপুর বছিলায় ৪০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন খালি জায়গা। এছাড়া ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাঁচপুরা বেপারিপাড়ার রহমান নগর আবাসিক প্রকল্প এলাকা ও তেজগাঁও পলিটেকনিকের খেলার মাঠ।
এদিকে বিগত বছরের ন্যায় এবারও অনলাইনে পশু বেচাকেনা হবে। সেই লক্ষ্যে চতুর্থবারের মতো এবারও তারা কোরবানির পশুর ডিজিটাল হাট চালু করবে। ডিএনসিসির ডিজিটাল হাটে ই-ক্যাব এবং বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস এ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের খামারিরা পশু বিক্রি করতে পারবেন। এবার কোরবানিতে অনলাইনে পশু বিক্রি জমজমাট হয়ে উঠছে। এছাড়া জনপ্রিয় হচ্ছে অনলাইন ভাগে কোরবানি।
অনলাইনে পশু কেনাবেচায় র্যাবের সতর্কতা ॥ অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচায় ক্রেতা-বিক্রেতাকে সতর্ক করেছে র্যাব। যদি এ ধরনের কোনো প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনভিত্তিক বিজ্ঞাপন দিয়ে কোরবানির পশু বিক্রি হচ্ছে। অনলাইনভিত্তিক সব ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ-গ্রুপে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ছবিতে এক আর বাস্তবে অন্য পশু দিলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনলাইন মাধ্যমগুলো থেকে কেউ পশু কিনতে গিয়ে প্রতারিত হলে র্যাব কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করুন। আমাদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনলাইনে কেনাকাটা সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে অনলাইন শপিং হয়। এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রতারণার অভিযোগ আমরা পেয়েছি। যে কেউ অনলাইনে কেনাকাটায় প্রতারিত হলে আমাদের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করলে ব্যবস্থা নেব।
ঈদের সময় মার্কেট, শপিংমলগুলোতে মানুষের ভিড় হয়। সেখানে ছিনতাইকারী ও মলম পার্টির খপ্পরে পড়েন অনেকে। অনেকে কেনাকাটা করতে গিয়ে ইভটিজিংয়ের শিকার হন। এসব বিষয় মাথায় রেখে র্যাব বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। ঈদযাত্রাকে নির্বিঘ্ন করতে লঞ্চ, ফেরি, বাস স্টপেজে বিশেষ র্যাবের নজরদারি থাকবে ও গোয়েন্দা সদস্যরা সর্বক্ষণিক মনিটরিং করবেন। ঈদে ঘরমুখো মানুষ যেন নির্বিঘ্নে যাত্রা করতে পারেন কোনো প্রতিবন্ধকতায় পড়তে না হয় সেজন্য র্যাবের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। ঘরমুখো মানুষ ছিনতাইকারী ও মলম পার্টির খপ্পরে না পড়েন সেজন্য গোয়েন্দা শাখা ও ব্যাটালিয়ন সদস্যরা কাজ করছেন।
একশ্রেণির ব্যবসায়ী কোরবানির চামড়া মজুত ও দাম কমিয়ে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেন জানিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ চলছে। এবার যেন দেশবাসী প্রতারিত না হন, ন্যায্যমূল্য পান সেজন্য নজরদারি রাখছে র্যাব। ঈদ জামাতকে কেন্দ্র করে র্যাবের বিশেষ নিরাপত্তা থাকবে। অতীতে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটলেও আগামীতে হামলার হুমকি নেই। গোয়েন্দা কার্যক্রম চলমান। ঈদকে কেন্দ্র করে কোনো জঙ্গি হামলার শঙ্কা এখনো নেই উল্লেখ করে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, যেহেতু শোলাকিয়াসহ ঈদ জামাতে হামলার ঘটনা ঘটেছিল। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেব।
উল্লেখ্য, কয়েক বছর ধরে হাটে না গিয়ে ঘরে বসে ঝামেলাহীনভাবে অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভাগে পশু কোরবানি দিতে চাইলে নির্ধারিত অঙ্কের টাকা দিয়েও কোরবানিতে অংশ নেওয়া যাবে। তবে অনলাইনে পশু কিনতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন অনেকেই। দাম অনুযায়ী পশু না পাওয়া কিংবা ছবিতে একটি দেখিয়ে অন্য পশু দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। এমনকি বছর দুই আগে অনলাইনে গরু কিনতে গিয়ে প্রতারিত হন খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ১ লাখ টাকা আগাম পেমেন্ট করলেও তিনি কাক্সিক্ষত গরুটি পাননি। এ ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে এবার র্যাব অনেক কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করেছে।