বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) নির্ধারিত খুচরা মূল্য ৯৯৯ টাকায় (১২ কেজি) মিলছে না এলপি গ্যাস। খুচরা বিক্রেতাকেই কিনতে হচ্ছে ১০৫০ থেকে ১১ শ টাকা দরে, এরসঙ্গে নিজের মুনাফা যোগকরে বিক্রি করছেন তারা।
রংপুর জেলার খুচরা এলপি গ্যাস বিক্রেতা আব্দুল কাফি এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন বার্তা২৪.কমকে। অথচ খুচরা বিক্রেতার কমিশন আলাদা করে রেখেই ঘোষণা দিয়ে আসছে বিইআরসি। আরও একজন খুচরা বিক্রেতা একই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি রংপুর গ্যাস কর্ণার থেকে সিলিন্ডার কিনেছেন। যিনি আজম জে চৌধুরীর ওমেরা গ্যাসের ডিলার।
বিইআরসি ঘোষিত জুলাই মাসের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৯৯৯ টাকার মধ্যে ডিলারের কমিশন ৩৪ টাকা এবং খুচরা বিক্রেতার ৩৮ টাকা রয়েছে। সে হিসেবে খুচরা বিক্রেতার কাফির মতো খুচরা বিক্রেতাদের ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম সর্বোচ্চ ৯৬১ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু ডিলাররা বিইআরসির আদেশকে মানতেই চাইছে না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে আমরাও বিইআরসি নির্ধারিত দরে কিনতে পাচ্ছি না। আমাদের কাছ থেকেই বেশি দর নিচ্ছে আমদানিকারকরা। তাই বাধ্য হয়ে আমরাও বেশি দামে বিক্রি করছি।
বিইআরসির বিগত একাধিক দর ঘোষণার সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হয়ে এলপিজি ডিস্ট্রিবিউটরদের সংগঠনের সভাপতি মোঃ সেলিম খান এর প্রতিকার চেয়ে আসছেন। গত ২ এপ্রিল বিইআরসি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দর ২৪৪ টাকা কমিয়ে ১১৭৮ টাকা নির্ধারণ করে। সেলিম খান ওই সাংবাদিক সম্মেলনেই প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আপনারা নতুন দর ঘোষণা করলেন। কিন্তু আমদানিকারকরা আজকে (২ এপ্রিল) মিল গেটে ১২ কেজির দর ঘোষণা করেছে ১২০০ টাকা। বিইআরসির হিসেব অনুযায়ী আমাদের (ডিস্ট্রিবিউটর) পাওয়ার কথা ১১০৬ টাকা দরে। এরপর আমাদের কমিশন ৩৪ টাকা এবং খুচরা বিক্রেতার কমিশন ৩৮ টাকা ধরে ভোক্তা পর্যায়ে ১১৭৮ টাকা হওয়ার কথা। অথচ আমাদেক ৯৪ টাকা বেশি দরে কিনতে হচ্ছে। আমাদের পক্ষে ১১৭৮ বিইআরসি ঘোষিত দরে বিক্রি করা সম্ভব নয়।
সেদিন অভিন্ন অভিযোগ করেছিলেন বাংলাদেশ এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির অর্থ সম্পাদক তাহের এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবু তাহের কোরাইশী। ওমেরা এলপি গ্যাসের ওই ডিস্ট্রিবিউটর দাবী করেন, তাদের কোম্পানিও মিলগেটে ১২০০ টাকা দর ঘোষণা করেছে। তাদের কমপক্ষে ৯০ টাকা কমিশন না হলে লোকসান দিতে হবে।
জবাবে বিইআরসির চেয়ারম্যান নুরুল আমিন সেদিন বলেছিলেন, আমরা বিষয়টি দেখবো। মালিকদের সঙ্গে বসে নির্ধারিত দরে বিক্রির বিষয়ে নিশ্চিত করা হবে। যদি কোন মালিক কথা না শুনতে চায় তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এরপর এলপিজি আমদানিকারকদের সঙ্গেও বৈঠক করা হয়। সেই বৈঠকে নির্ধারিত দরে এলপি গ্যাস বিক্রির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বলে বিইআরসি সুত্র জানিয়েছে।
রংপুর গ্যাস কর্ণারের স্টাফ রাসেল ১০৫০ টাকা দরে বিক্রি করার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমাদেক নতুন দর দেওয়া হয়েছে ১০৫০ টাকা, আমরা সেভাবেই বিক্রি করছি। এখানে কোন লুকোচুরি নেই, আমরা যে দরে বিক্রি করছি তার ক্যাশমেমো দিচ্ছি।
বিইআরসি ঘোষিত দরে বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, তারা যে দর ঘোষণা করছে সেখানে ভ্যাট ট্যাক্স নেই, ভ্যাট-ট্যাক্স যোগ করে দাম বেড়ে যাচ্ছে। এরসঙ্গে রয়েছে পরিবহন ভাড়া। বিইআরসি ঘোষিত দরে ভ্যাট-ট্যাক্স রয়েছে জানালে তিনি বলেন, আমি এখানে চাকরি করি এর বেশি জানি না।
এ প্রসঙ্গে বিইআরসির চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, বেশি দর নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমরা আজকে (৫ জুলাই) সব জেলা প্রশাসক ও ভোক্তা অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য। আর কাল-পরশু থেকে আমরাও নামতেছি।
মালিকরাই বেশি দর নিচ্ছে এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, দর নির্ধারণ করার সময় মালিকদের প্রতিনিধি থাকেন। তাদের দাম বেশি নেওয়া কোন সুযোগ নেই। অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২০২১ সালের ১২ এপ্রিল প্রথম এলপি গ্যাসের দর ঘোষণা করে বিইআরসি। তখন এলপিজি আমদানিকারক, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার জন্য ১২ কেজির সিলিন্ডারে মোট ৩৫৯ দশমিক ৪০ টাকা কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছিল। দর ঘোষণার দিনেই কমিশনের পরিমাণ নিয়ে আপত্তি তোলেন লোয়াব (এলপিজি আমদানিকারকদের সংগঠন)। এরপর থেকে বিইআরসির সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয় লোয়াবের। তারা প্রতিমাসের দর ঘোষণাও বর্জণ করে বিভিন্নভাবে বিইআরসির উপর চাপ তৈরি করে। এমনকি এলপিজি আমদানিবন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয় লোয়াবের সভাপতি আজম জে চৌধুরী। বিইআরসি অনেকটা বাধ্য হয়ে ৭ মাসের মাথায় ১০ অক্টোবর ৩৫৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৪১ টাকা করেন। অর্থাৎ ১২ কেজি সিলিন্ডারে এবার কমিশন বাড়ানো হয়েছে ৮১ দশমিক ৬ টাকা। ডিলার এবং খুচরা বিক্রেতার কমিশন বাড়িয়ে যথাক্রমে ৩৪ ও ৩৮ টাকা করা হয়েছে।
প্রথমবারের মতো এলপি গ্যাসের দর ঘোষণার সময় বলা হয়, যেহেতু পণ্যটি প্রায় ৯৮ শতাংশ আমদানির উপর নির্ভরশীল। সে কারণে সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে প্রতি মাসের ভিত্তি মূল্য ধরা হয়েছে। সৌদির দর উঠা-নামা করলে এলপিজির মুল্য উঠা-নামা করবে। আমদানিকারকের অন্যান্য কমিশন ও খরচ অপরিবর্তিত থাকবে। কমিশনের সেই নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি মাসে দর ঘোষনা করে এসেছে। যদিও বিইআরসি ঘোষিত দর খুব কম ক্ষেত্রেই কার্যকর হতে দেখা গেছে।