নির্বাচনকালীন সরকার বলে কিছু নেই সংবিধানে বিদ্যমান সরকারই বহাল থাকবে

নির্বাচনকালীন সরকার বলে কিছু নেই সংবিধানে বিদ্যমান সরকারই বহাল থাকবে

বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ৩০ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের তিন মাসের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সে হিসেবে আগামী নভেম্বর মাস থেকে শুরু হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।

এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে এবং কারা থাকবে সেই সরকারে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে নানা আলোচনা। এ নিয়ে অবশ্য দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল পরস্পরবিরোধী কঠোর অবস্থানে অনড় রয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে জোরালো আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। তবে সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলছেন, সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার বলে কিছু উল্লেখ নেই। তাই নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকার বহাল থাকতে পারে অথবা নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রী চাইলে অন্য দলগুলোর প্রতিনিধি নিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে পারেন, যেমনটা ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের সময় করা হয়েছিল। তবে এটা করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা সংবিধানে নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি একাধিক সভায় স্পষ্ট করে বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কয়েক দিন ধরেই বলছেন, আন্দোলনের মাধ্যমে এবার নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে ক্ষমতাসীনদের বাধ্য করা হবে। জবাবে সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, বিএনপির এ দাবি মানার কোনো সুযোগ নেই এবং সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন হবে। ফলে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সংলাপের মাধ্যমে কোনো সমঝোতা হবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়।

আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়েছিল। তবে ২০১১ সালে উচ্চ আদালতের একটি রায়ের ভিত্তিতে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় বর্তমান সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার কোনো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। এ ছাড়া সংবিধান অনুযায়ী সরকারের নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদও নেই। সরকারের মেয়াদ হচ্ছে একটি সরকার নতুন নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা পর্যন্ত। কারণ সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি- (১) (ক) তিনি কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন; অথবা (খ) তিনি সংসদ-সদস্য না থাকেন। (২) সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিবেন কিংবা সংসদ ভাংগিয়া দিবার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শদান করিবেন এবং তিনি অনুরূপ পরামর্শদান করিলে রাষ্ট্রপতি, অন্য কোন সংসদ-সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নহেন এই মর্মে সন্তুষ্ট হইলে, সংসদ ভাংগিয়া দিবেন। (৩) প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না।’

সংবিধানের ৫৮ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘(১) প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি- (ক) তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন; (খ) তিনি সংসদ-সদস্য না থাকেন, তবে ৫৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার শতাংশের অধীনে মনোনীত মন্ত্রীর ক্ষেত্রে ইহা প্রযোজ্য হইবে না।’ (৩) সংসদ ভাংগিয়া যাওয়া অবস্থায় যে-কোন সময়ে কোন মন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের (১) দফার (ক), (খ) ও (ঘ) উপ-দফার কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না। (৪) প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকিলে মন্ত্রীদের প্রত্যেকে পদত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে; তবে এই পরিচ্ছেদের বিধানাবলী-সাপেক্ষে তাহাদের উত্তরাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাহারা স্ব স্ব পদে বহাল থাকিবেন।’ তাই সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া হলেও সরকারের ওপর তার কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা স্বীয় পদে বহাল থাকবেন।

সংবিধানের ১১৯ নং অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে (১) রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান ও আইনানুযায়ী (ক) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; (খ) সংসদ-সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; (গ) সংসদে নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবেন; এবং (ঘ) রাষ্ট্রপতির পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুত করিবেন।

অন্যদিকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এবং নির্বাচনি বিধিমালার আলোকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়নসহ কিছু কিছু কাজে সরকারকে কমিশনের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে।

আইনবিদরা বলছেন, নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। এক্ষেত্রে সরকারের কর্তব্য হবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনকে সহায়তা করা। নির্বাচনের সময় সরকারের আকার ছোট করা বা শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যদি আন্দোলনকারী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে কোনো সমঝোতা হয় তা হলে প্রধানমন্ত্রী চাইলে মন্ত্রিসভার আকার ছোট করে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন দল এবং প্রয়োজনে বিএনপির প্রতিনিধিদের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে নির্বাচনকালীন সরকারে নিতে পারবেন।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকারের কথা উল্লেখ নেই। তবে সংবিধানের মধ্য থেকেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা সম্ভব। তার মতে, বর্তমান সংবিধান সমুন্নত রেখেই সংসদ ভেঙে দেওয়া বা নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে টেকনোক্র্যাট হিসেবে বিরোধী দলকে নেওয়া যেতে পারে।

মৎস্য ও পশু সম্পদমন্ত্রী স ম রেজাউল করিম জানান, সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন বা নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো বিধান না থাকায় নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকারই স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব পালন করে যাবে। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় সরকারের আকার ছোট করতে হবে এমন কোনো বিধান সংবিধানে নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী চাইলে সরকারের আকার ছোট বা বড়ও করতে পারেন। আর বর্তমান নির্বাচিত সরকার পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বর্তমান সরকারই নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করবে। আর নির্বাচনকালীন সরকারের আকার কী হবে সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ঠিক করবেন। তাই নির্বাচনকালীন নতুন কোনো সরকার গঠনের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই, বাধ্যবাধকতাও নেই। তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপি যতই রূপরেখা দিক না কেন, সংবিধান অনুযায়ীই দেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

জাতীয়