বাংলাদেশের সোয়া পাঁচ কোটির বেশি মানুষ খাদ্যে তীব্র থেকে মাঝারি ধরনের নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে আছে। এর মধ্যে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে ১ কোটি ৮৭ লাখ মানুষ। জাতিসংঘের পাঁচ সংস্থার বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিসংক্রান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘের পাঁচ সংস্থার মধ্যে আছে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ), জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ‘দ্য স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গত বুধবার প্রকাশিত হয়।
দেশে তীব্র থেকে মাঝারি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের সংখ্যা ২০১৬ সালের পর গত ছয় বছরে প্রায় ১৮ লাখ বেড়েছে।
মানুষের খাদ্যবহির্ভূত ব্যয়ও বেড়েছে। এর মধ্যে বাড়িভাড়া, স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মতো বিষয় আছে। বাড়তি চাপে মানুষ খাদ্য কেনা কমিয়ে দেয় বা দিতে বাধ্য হয়
হোসেন জিল্লুর রহমান, অর্থনীতিবিদ
প্রতিবেদনে তীব্র খাদ্যসংকটের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এটা এমন এক পরিস্থিতি, যখন মানুষের খাবার ফুরিয়ে যায়, কোনো কোনো দিন অভুক্ত থাকে। মানুষের স্বাস্থ্য বড় ধরনের ঝুঁকিতে থাকে।
মাঝারি ধরনের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এটা এমন এক পরিস্থিতি, যখন মানুষের খাদ্য পাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা থাকে। বছরের কোনো কোনো সময় তাদের খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয় অথবা খাবারের পরিমাণ ও মানের অবনমন ঘটে। অর্থ ও অন্য সম্পদের ঘাটতিতেই এমনটা ঘটে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে যত মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটে ভুগত, করোনা মহামারির কারণে তার সঙ্গে আরও ১২ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ যোগ হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে যে হারে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব তো নয়ই, উল্টো এই সময়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা আরও ৬০ কোটি বাড়বে।
করোনাকালে নতুন করে মানুষ দরিদ্র হয়েছে, তা আমরা বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখিয়েছি। সে সময় আয়ের যে ধাক্কা মানুষ পেয়েছিল, সেটা অনেকেই সামলাতে পারেনি। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি।
অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ৫ কোটি ২৭ লাখ মানুষ ছিল। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৯ লাখ। মাঝারি মাত্রার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকা মানুষ বাড়লেও তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের সংখ্যা কমেছে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৯ লাখ। ২০২২ সালে এই সংখ্যা কমে হয়েছে ১ কোটি ৮৭ লাখ।
খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার কারণে মানুষের পুষ্টিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুষ্টির অভাবে বাংলাদেশের পাঁচ বছর বয়সী ৩৯ লাখ শিশু খর্বকায়।
প্রতিবেদনের বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, করোনার কারণে কিছু মানুষের আয় কমেছে; তাতে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে দেশে পুষ্টির মান গত ১৩ থেকে ১৪ বছরে অনেক বেড়েছে। তিনি উপাত্ত তুলে ধরে বলেন, ২০০৯ সালে দেশে সবজির উৎপাদন ছিল ৩০ লাখ টন। এখন এর পরিমাণ ২ কোটি ২০ লাখ টন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ৫ কোটি ২৭ লাখ মানুষ ছিল। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৯ লাখ। মাঝারি মাত্রার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকা মানুষ বাড়লেও তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের সংখ্যা কমেছে।
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ২২ শতাংশ পরিবার বন্যা এবং ১৬ শতাংশ মানুষ নদীভাঙনের শিকার। ফলে শুধু ক্ষুধা নিয়েই দুশ্চিন্তা বাড়ছে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা মহামারির প্রভাবে মানুষের আয়ের ওপর প্রভাব পড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এসবের ফলে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি, বেড়েছে খাবারের দাম। তাতে কোটি কোটি মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।
জাতিসংঘের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের এই প্রতিবেদনকে বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাকালে নতুন করে মানুষ দরিদ্র হয়েছে, তা আমরা বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখিয়েছি। সে সময় আয়ের যে ধাক্কা মানুষ পেয়েছিল, সেটা অনেকেই সামলাতে পারেনি। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি।’
হোসেন জিল্লুর বলেন, মানুষের খাদ্যবহির্ভূত ব্যয়ও বেড়েছে। এর মধ্যে বাড়িভাড়া, স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মতো বিষয় আছে। বাড়তি চাপে মানুষ খাদ্য কেনা কমিয়ে দেয় বা দিতে বাধ্য হয়।