চট্টগ্রাম নগরীর ওয়াসা মোড়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নির্বাচনী অফিসে হামলার পর মহানগর বিএনপির অফিসের সামনে আগুন দেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
সংবিধান মেনে নিজেদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে ক্ষমতাসীনেরা। অন্যদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে রাজপথের লড়াইকে বেছে নিয়েছে বিএনপি। না আওয়ামী লীগ, না বিএনপি—একচুলও ছাড় দিচ্ছে না কেউ।আগামী নির্বাচন ঘিরে দুই দলের এমন অবস্থান নিয়ে সংঘাতের যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, মনে হচ্ছে দেশ সেদিকেই যাচ্ছে।
এতে সাধারণ নাগরিকদের মনে শঙ্কা-উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই পরিস্থিতির লাগাম টানতে না পারলে সামনে দেশ এক ভয়ানক বিপদের মুখে পড়তে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুই দলের সমঝোতা না হলে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হতে পারে। এই অবস্থায় দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্য উভয় দলকেই সহনশীল হতে হবে।সমঝোতা করতে হবে।’ যদিও দুই দলের কর্মকাণ্ডে সমঝোতার কোনো লক্ষণ এখনো দেখছেন না এই অধ্যাপক।
সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন শুরু করেছে বিএনপি ও তাদের সমমনা দল ও জোটগুলো। এই কর্মসূচির প্রথম দিন ছিল গত মঙ্গলবার। আগের দিনগুলোর মতো সেদিনও রাজপথে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ। তাদের কর্মসূচি ছিল শান্তি ও উন্নয়ন শোভাযাত্রা।
রাজপথে অনেক জায়গায় মুখোমুখি হয়ে যায় দুই পক্ষ। হামলা-সংঘর্ষ হয় ঢাকা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কিশোরগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, জয়পুরহাট, বগুড়া, পিরোজপুর ও রাজবাড়ীতে। এর মধ্যে সংঘর্ষে লক্ষ্মীপুরে প্রাণ হারান কৃষক দলের এক নেতা। আর সব জায়গা মিলিয়ে আহত দুই দলের নেতা-কর্মী ও পুলিশসহ প্রায় ৫০০।
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সেদিন রাজধানীসহ জেলা ও মহানগরে পদযাত্রা করে বিএনপি। রাজধানীতে সাত ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটার হেঁটে সরকারকে কঠোর বার্তা দেয় দলটি। সরকারের পদত্যাগ দাবি করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘পদত্যাগ করেন। নইলে ফয়সালা হবে রাজপথে।’
গতকাল বুধবার রাজধানীর উত্তরায় দিনব্যাপী পদযাত্রার উদ্বোধনকালে সরকারকে আর ছাড় না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, ‘ছেড়ে দেওয়ার দিন শেষ। আর কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না।’ তাঁদের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে, চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে তাঁরা মরিয়া।
গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তার মোড়ে আওয়ামী লীগের শান্তি ও উন্নয়ন শোভাযাত্রার আগে বিএনপিকে প্রতিহত করার কথা বলেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘তাদের (বিএনপি) প্রতিহত করতে হবে। নির্বাচনে বাধা দিতে আসলে আমরা প্রতিহত করব।’ তাহলে কেউই আর ছাড় দিতে চাইছে না।
চলমান আন্দোলন ঘিরে এর আগেও বিএনপির ১৭ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন বলে দলটির দাবি। গতকাল সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, গত দুই দিনের কর্মসূচি ঘিরে একজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি অন্তত ২ হাজার নেতা-কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, আহত অন্তত ৩ হাজার। এ ছাড়া গত দুই দিনের ঘটনায় ৩১০টি মামলায় ১১ হাজারের অধিক নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এ সময়ে অন্তত ১ হাজার ৩০০ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন রিজভী।
বিরাজমান সংকটের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলের ভূমিকাকেই দায়ী করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্রের কথা বলে—আওয়ামী লীগ, বিএনপি—কেউই আসলে গণতন্ত্রমনা নয়, তাদের ভেতরেই গণতন্ত্র নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যা করার—দল দুটি তা-ই করে, জনগণের অধিকার রক্ষার কথা বলে আন্দোলন করে। আওয়ামী লীগ হোক, আর বিএনপিই হোক—ক্ষমতায় গেলে সব ভুলে যায়। ক্ষমতায় যাওয়ার পর তারা আবারও যেনতেনভাবে হলেও ক্ষমতায় থাকার জন্য চেষ্টা করে। এখন দেশে যা হচ্ছে, তা-ও অতীতেরই ধারাবাহিকতা। দুই দলের কেউই সহনশীল নয় বলে দেশে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থায় সহনশীল হয়ে দুই দলকে সমঝোতার পথেও হাঁটার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘আমরা সহনশীল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছি। তারাই (আওয়ামী লীগ) আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আক্রমণ করেছে। আমরা মার খেয়ে মার হজম করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি দলকেই সহনশীল হতে হয়। তা না করে তারা আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ফ্যাসিস্ট কায়দায় বাধা দিচ্ছে, আক্রমণ করছে। যে কারণে আজকের এই সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীরা নিয়ন্ত্রণে আছে। আশা করি কোনো সংঘাত হবে না। বিএনপি-জামায়াত করলে করতে পারে। সেটা তাদের ব্যাপার। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কিছু হবে না।’
দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘এই মুহূর্তে দেখতেছি না। ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে।’।