নির্বাচন পর্যন্ত  রাজনীতিতে  উত্তাপ

নির্বাচন পর্যন্ত রাজনীতিতে উত্তাপ

আন্দোলনের কৌশল চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় নির্বাচনের আগে এক দফা দাবি আদায়ে সরকারকে চাপে ফেলতে রাজধানীতে কয়েক দফা মহাসমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। এর প্রথমটি ২৭ জুলাই, দ্বিতীয়টি সেপ্টেম্বরে এবং নির্বাচনের আগে আরও অন্তত একটি মহাসমাবেশ করবে। এতে সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের জড়ো করে রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করে রাজপথ দখলে নিতে চায় দলটি। তবে মাঠ ছাড়বে না আওয়ামী লীগও। ধারাবাহিক পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে রাজপথ দখলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগও। ২৭ জুলাই রাজধানীতে পালিত হবে দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি। বিএনপির মহাসমাবেশের বিপরীতে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ‘তারুণ্যের জয়যাত্রা’ সমাবেশ করবে। বড় দুই দলের মাঠ দখলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নির্বাচন পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে উত্তাপ থাকবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে।

জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র পাঁচ মাস বাকি। তাই দাবি আদায়ের বিষয়ে সরকারকে আর সময় দিতে চাচ্ছে না বিএনপি। সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবি আদায়ে সারাদেশের সকল মহানগর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ধারাবাহিক সভা-সমাবেশ করার মধ্য দিয়ে প্রস্তুতি জোরদার করে ঢাকার মহাসমাবেশ সফল করার মধ্য দিয়ে সরকারকে বড় ধরনের চাপে ফেলার চেষ্টা করবে। এ জন্য যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোরও সমর্থন নেওয়া হবে। এর বিপরীতে সরকারি দল আওয়ামী লীগও বিএনপিকে রাজপথে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে প্রস্তুতি জোরদার করেছে। সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৪ দলীয় জোটগতভাবেও রাজপথে জোরদার কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সূত্র মতে, এবার তৃণমূল থেকে আন্দোলনের ঢেউ কেন্দ্রে নিয়ে আসার নতুন কৌশল নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা ও মহানগর সদরে কর্মসূচি পালন করে শক্তি সঞ্চয় করে মহাসমাবেশ কর্মসূচিগুলো সফল করতে রাজধানীতে আনা হবে দলের নেতাকর্মীদের। ২০১৩ সালের মতো ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচির আদলে রাজধানীতে একটি বড় মহাসমাবেশ কর্মসূচি পালন করে দাবি আদায় করতে চায় দলটি।

এদিকে সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে থেকে রাজপথের বিরোধী দলের আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে আওয়ামী লীগও বার্তা দিয়েছে। দলের হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় তৃণমূল পর্যায়ের সকল ইউনিট কমিটি যেন বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকে। কোনো অবস্থাতেই যেন বিএনপি মাঠ দখলে নিতে না পারে। এ জন্য সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের জাতীয় নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়।

উল্লেখ্য, গত বছর মধ্যভাগ থেকে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করার চেষ্টা করলেও শেষ দিকে গিয়ে সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সক্রিয় করতে সক্ষম হয়। ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ থেকে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে রাজপথে ঘন ঘন কর্মসূচি পালন করতে থাকে। সর্বশেষ ১২ জুলাই নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে ঘোষণা করা হয় আন্দোলনের এক দফা কর্মসূচি।

গত ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে বিএনপির কর্মসূচির দিনে আওয়ামী লীগও পাল্টা নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে রাজপথ নিজেদের দখলে রেখেছে। অধিকাংশ কর্মসূচিতে বিএনপির চেয়েও বেশি সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ঘটিয়ে রাজনৈতিকভাবেই নিজেদের শক্তির মহড়া দিয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এভাবেই তারা মাঠ দখলে রেখে বিএনপির আন্দোলনের জবাব দেবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

সূত্র মতে, সম্প্রতি বিএনপির দলীয় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আন্দোলনের চূড়ান্ত কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সময় তৃণমূল থেকে ধাপে ধাপে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে রাজধানীতে মহাসমাবেশ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের শোডাউনের চেষ্টা করবে। এতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোকেও সক্রিয় রাখা হবে।

গত বছর ১০ ডিসেম্বর আন্দোলনের ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর প্রথম দফায় ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা ছাড়া সকল মহানগর ও জেলা সদরে গণমিছিল কর্মসূচি পালন করে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো। তবে ওইদিন রাজধানীতে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন থাকায় ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় পালন করা হয় গণমিছিল কর্মসূচি। এর পর থেকে বিএনপি এককভাবে এবং সমমনা দলগুলোকে নিয়ে ধাপে ধাপে সমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রা ও গণমিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের পর গত ১২ জুলাই পল্টনের সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হয় আন্দোলনের এক দফা কর্মসূচি। একই দিন আওয়ামী লীগও বিশাল সমাবেশ করে রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে মোকাবেলা করে।

দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক শক্তি জোরদার করার কৌশল নিয়ে বিএনপি কর্মসূচি জোরদার করার চেষ্টা করে। এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে ঘরবন্দি হয়ে থাকা বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী গত বছর জুলাই মাস থেকে দেশব্যাপী শুরু হওয়া ধারাবাহিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে দলীয় কর্মকা-ে সক্রিয় হতে থাকে। আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপির দাবি অনুসারে ইতোমধ্যেই ১৮ জন মারা গেছে। আর মামলা-হামলার শিকার হয়েছে আরও অনেকে। তার পরও আগের চেয়ে কিছুটা সাহসী হয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা। এ কারণে এখন দলটির যে কোনো কর্মসূচিতে আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বিএনপির আন্দোলন করে সরকার পতনের হুমকির জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবেই হবে। তবে এ নির্বাচন হবে সংবিধান অনুসারে। সংবিধানের বাইরে একচুলও ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই আশা করছি বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে নির্বাচনে অংশ নেবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, ধারাবাহিকভাবে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমেই সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবি আদায় করা হবে। তিনি বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীরা এখন আর ভয় পায় না, তাই যে কোনো কর্মসূচিতে তাদের উপস্থিতি দিন দিনই বাড়ছে। এ ছাড়া দেশের সাধারণ মানুষও বিএনপির দাবি সমর্থন করছে। তাই আন্দোলন বেগবান হচ্ছে। আন্দোলনেই এক দফা দাবি আদায় করা হবে।

২৭ জুলাই দুই দলের শোডাউনের প্রস্তুতি ॥ ২৭ জুলাই রাজপথের বিরোধী দল খ্যাত বিএনপি ও এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগ রাজধানীতে নিজ নিজ কর্মসূচি পালনকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের শোডাউনের প্রস্তুতি জোরদার করছে। ইতোমধ্যেই দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল নিজ নিজ দলের কর্মসূচি সফল করতে বিভিন্ন স্তরের নেতাদের নিয়ে প্রস্তুতি সভা করেছে। বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে উপস্থিত থাকতে বিভিন্ন ইউনিট কমিটিগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, ২২ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশে যত নেতাকর্মীর উপস্থিতি ঘটেছে তারচেয়ে অনেক বেশি নেতাকর্মী ‘তারুণ্যের জয়যাত্রা’ সমাবেশে উপস্থিত হবে।

সূত্র জানায়, ২৭ জুলাই বেলা ২টায় রাজধানীর নয়াপল্টন অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করতে চায় বিএনপি। তবে পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষে ভেন্যু চূড়ান্ত হবে। বিএনপির মহাসমাবেশ কর্মসূচিতে সারাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী জড়ো করা হবে। ইতোমধ্যেই ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিট ও আশপাশের বিভিন্ন জেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর এই সমাবেশ থেকে আন্দোলনের আরও কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এসব কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি সেপ্টেম্বরে আরও একটি মহাসমাবেশ করবে। এর পর জাতীয় নির্বাচনের আগে আরও অন্তত একটি মহাসমাবেশ করবে বিএনপি।

বিএনপির মহাসমাবেশ কর্মসূচির দিনে ২৭ জুলাই রাজধানীতে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের ঢাকা বিভাগীয় ‘তারুণ্যের জয়যাত্রা’ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এটি আজ ২৪ জুলাই হওয়ার কথা থাকলেও পরে বৃহস্পতিবার করার সিদ্ধান্ত হয়। যুবলীগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ডিজিটাল প্রবাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে আওয়ামী যুবলীগের দেশব্যাপী ‘তারুণ্যের জয়যাত্রা’ সমাবেশের ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ ২৭ জুলাই বৃহস্পতিবার বেলা ২টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম গেটে অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ঢাকা মহানগর উত্তর, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, গাজীপুর মহানগর, নারায়ণগঞ্জ মহানগর ও টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ঢাকা জেলা এবং ময়মনসিংহ জেলার সমন্বয়ে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ এবং সঞ্চালনা করবেনÑ সাধারণ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিল।

রাজনীতি