দেশের ব্যাংক খাতে যে অস্থিরতা চলছে, তার জন্য মুষ্টিমেয় প্রভাবশালীরা দায়ী। ক্ষমতাচর্চার ফলে আইন ও নীতিকে পাশকাটিয়ে ব্যাংক খাতে চলছে লুটপাট। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২২ সালভিত্তিক এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, অর্থনীতির অন্যতম উদ্বেগজনক সূচক খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেকই পাঁচ ব্যাংকে। আর প্রভাবশালী তিন গ্রাহকের কাছে জিম্মি ১১টি ব্যাংক। ফলস্বরূপ মোট ঋণস্থিতির ৮৯ শতাংশই মন্দ মানে রয়েছে। খেলাপির খাতায় আছে আট শতাংশের বেশি ঋণ এবং বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের অঙ্ক সাড়ে ১৪ শতাংশ। এছাড়া বড় অঙ্কের ঋণ প্রচলিত ঋণ খাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ তিন শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন (ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট) অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণস্থিতি দাঁড়ায় ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয় এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের আট দশমিক ১৬ শতাংশ। একই সময়ে ঋণ অবলোপনের অঙ্ক দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৪৯৩ টাকা এবং বকেয়া পুনঃতফসিল করা ঋণ দুই লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা; যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। সব মিলে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে বিপদগ্রস্ত ঋণ ছিল তিন লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে এসব অঙ্ক আরও বেড়েছে।
এর আগে বর্তমান গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই বিশেষ ছাড় দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রভাবশালী চক্রকে খুশি করতেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে আলোচনা-সমালোচনা হয়। কোনোরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই গভর্নর হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, খেলাপি ঋণ কম দেখাতে পুনঃতফসিলের নীতি উদার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন চাইলে নিজেরাই যে কোনো ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারছে। নীতিছাড়ের এ সুযোগে ব্যাংকগুলোও ঋণ পুনঃতফসিলের রেকর্ড গড়েছে। শুধু ২০২২ সালেই ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত দুই লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩১ দশমিক সাত শতাংশ ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে শিল্প খাতের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০ দশমিক পাঁচ শতাংশ ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের। পুনঃতফসিল করা ঋণের ৭১ শতাংশই করেছে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এসব ঋণের ১৯ শতাংশ আবারও খেলাপির খাতায় উঠেছে। অর্থাৎ, বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতেই ঋণ পুনঃতফসিল ও অবলোপন করা হচ্ছে। কারণ, শিল্প-বস্ত্র ও বেসরকারি ব্যাংক— এ সবই ক্ষমতাধর কেন্দ্রে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত। এছাড়া কিস্তি পরিশোধ করার নির্ধারিত তারিখের পর ছয় মাসের বেশি সময় ধরে বকেয়া থাকলে তাকে সন্দেহজনক মানে শ্রেণিকৃত করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনমতে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের মধ্যে সন্দেহজনক মানের ঋণ ছিল ছয় দশমিক ৭৯ শতাংশ। ৯ মাসের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণকে নিম্নমানে শ্রেণিকরণ করা হয়। আলোচিত সময়ে নিম্নমানের ঋণ চার দশমিক ৫৪ শতাংশ। অন্যদিকে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেকই পাঁচটি ব্যাংকে। অর্থাৎ ধারাবাহিক বেড়ে চলা খেলাপি ঋণের যে নেতিবাচক চাপ অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছে, তার জন্য বেশি দায়ী এসব ব্যাংক। মোট খেলাপি ঋণের ৪৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ রয়েছে ব্যাংকগুলোতে। আর দেশে কার্যরত ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ১০টির খেলাপি স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বাকি ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ৩৫ দশমিক ২৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের জন্যও মুষ্টিমেয় বড় গ্রাহক দায়ী। তাদের কাছেই পুরো ব্যাংক খাত জিম্মি হয়ে পড়েছে। এছাড়া ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের ৮৯ শতাংশই মন্দ বা ক্ষতিজনক পর্যায়ে শ্রেণিকৃত। এক বছরের বেশি সময় এসব ঋণের কিস্তির অর্থ আদায় করতে পারেনি ব্যাংকগুলো।
প্রতিবেদনে ঋণের শীর্ষে থাকা গ্রাহকরা খেলাপি হলে কী ঝুঁকিতে পড়বে— তা নিরূপণ করা হয়েছে। তবে শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। এতে বলা হয়, ব্যাংকের শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে ব্যাংকগুলোর ন্যূনতম মূলধন সক্ষমতা (সিআরএআর) কমে ১০ দশমিক ১১ শতাংশে নামত। আর যদি ব্যাংকে তিন শতাংশ খেলাপি ঋণ বাড়ে, তাহলে ব্যাংক খাতের সিআরএআর নেমে দাঁড়াত ৯ দশমিক ৮২ শতাংশে। এখন ব্যাংক খাতের সার্বিক সিআরএআর আছে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
এছাড়া ব্যাংকগুলোতে যদি তিন শতাংশ খেলাপি বাড়ে, একইসঙ্গে শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হয়, তাহলে ২৯টি ব্যাংক মূলধন রাখতে ব্যর্থ হতো। একইসঙ্গে শীর্ষ ঋণগ্রহীতারা যদি খেলাপি হয়, তাহলে বেশিরভাগ ব্যাংক নির্ধারিত মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। অর্থাৎ তিনজন শীর্ষ ঋণগ্রহীতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে পুরো ব্যাংক খাত। তারা ঠিকমতো ঋণের কিস্তি না দিলে ব্যাংকগুলো মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নামে-বেনামে নতুন ঋণ নেয়ার পাশাপাশি নানা অবৈধ সুবিধা ভোগ করছে ওইসব প্রভাবশালী। বিশ্লেষকরা বলছেন, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে একক ঋণসীমা লঙ্ঘন করে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এখন সেসব গ্রাহকের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছে ব্যাংকগুলো। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো নীতি সুবিধা দিয়ে লুটপাটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
ব্যাংকিং বিধি ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী যে কোনো ধরনের ঝুঁকি এড়াতে একটি ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। এর সঙ্গে আপদকালীন সুরক্ষা মূলধন (ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার-সিসিবি) হিসেবে আরও আড়াই শতাংশ মূলধন রাখার বিধান করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১টি ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সক্ষমতা (সিআরএআর) রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। সিআরএআরের সঙ্গে দুই দশমিক ৫০ শতাংশ হারে (১২.৫ শতাংশ) সিসিবি বজায় রাখতে পারেনি আরও পাঁচ ব্যাংক। এখন যদি ব্যাংকের শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হয়, তাহলে আরও ১১টি ব্যাংক সিআরএআর রাখতে ব্যর্থ হবে। আমার সংবাদকে বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো নীতি সহায়তাসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। এর সুযোগ নিয়ে বেশকিছু ব্যাংক খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা হয়েছে। যেখানে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক নিয়মনীতি মানা হয়নি। এসব ঋণ যোগ করলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত অঙ্ক আরও অনেক বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো সঠিক নিয়মে খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে না। আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে তথ্য গোপন করছে। এটি বন্ধ না হলে ব্যাংকগুলো বড় ঝুঁকিতে পড়বে। বর্তমানে সরকারি ব্যাংকের মতো বেসরকারি ব্যাংকগুলোও অনিয়মে জড়াচ্ছে। এটি ব্যাংক খাতের জন্য খারাপ পরিণতি বয়ে আনবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২২ সালে ব্যাংক খাতের আমানতে প্রবৃদ্ধি ছিল পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ। এ সময় ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক পাঁচ শতাংশ। ফলে গেলো বছর তারল্যের ওপর চাপ ছিল ব্যাংকগুলোতে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে ৯ লাখ ১০ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা ধার দিয়েছে।।