যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়েই ঘুরছে দেশের রাজনীতি

যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়েই ঘুরছে দেশের রাজনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক
আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় দলে উদ্বেগের কথা স্বীকার করলেও আওয়ামী লীগ ‘বিচলিত নয়’ বলে দাবি করছেন দলের নেতারা। অন্যদিকে মার্কিন ভূমিকা তাদের দলের কর্মীদের ‘উজ্জীবিত করছে’ বলে মনে করছে বিএনপি। রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আমেরিকা সক্রিয় হওয়ার পর ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে সার্বিক রাজনীতিতেই।

নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার অবস্থান নিয়ে দুই প্রধান দলের মধ্যে বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে আমেরিকাকে ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্য। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেছেন, তারা তাকে ‘ক্ষমতায় দেখতে চায় না’। চলতি বছরের মে মাসে শেখ হাসিনা বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারেই বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না বলেই এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

সর্বশেষ এই সপ্তাহেই শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, গণতন্ত্র ও নির্বাচনের নাম করে তারা চায় যাতে করে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ চালানো যায় এবং তার ভাষায়- এই অঞ্চলের দেশগুলোকে ধ্বংস করাই হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য।

অনেকেই মনে করেন, সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থান নিয়েছে এবং যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভেতরে। সেটিকে সামাল দিতেই শক্ত ভাষায় কথা বলতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বিবিসিকে বলছেন, দলের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ আছে এটি সত্যি, কিন্তু এ নিয়ে আমরা বিচলিত নই। এ নিয়ে আমরাও কাজ করছি।

অন্যদিকে বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার গত কিছুদিনের পদক্ষেপে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীরা। দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, তার দল যেসব বিষয়ে আন্দোলন করছিল সেসব বিষয়ে আমেরিকাসহ বৈশ্বিক শক্তিগুলো অবস্থান নেয়ার বিষয়টি দলের সবাইকে উজ্জীবিত করেছে। আর আমেরিকার অবস্থানকে ঘিরে দুই দলের এমন বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়াকে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হিসেবে উল্লেখ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার।

আওয়ামী লীগে উদ্বেগ কতটা: আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের অন্যতম মো. আব্দুর রাজ্জাক গণমাধ্যমকে বলেছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমেরিকা যা করছে তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে দলে এবং সেটি নিয়ে তারাও সচেতন আছেন।

দলের মধ্যে হয়তো অনেকেই জানতে চান যে, কী চায় আমেরিকা। সেজন্যই প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন, কে কী চায় বা তাদের উদ্দেশ্য কী। আমরা যেটি বলতে চাইছি সেটি হলো- ইচ্ছে করলেই কেউ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারবে না। এটা ইরাক নয়, এটা বাংলাদেশ। এমনকি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও কেউ আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কোনো হিসেব করতে পারবে না মনে করেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি দলের মধ্যে আমেরিকাকে ঘিরে কী ধরনের আলোচনা হচ্ছে তা পরিষ্কার না করলেও দলটির একাধিক নেতা ধারণা দিয়েছেন যে, তৃণমূল থেকে কেন্দ্র- সব স্তরেই প্রশ্ন উঠছে যে- আমেরিকা আসলে কী চাইছে এবং তারা কতদূর যাবে অর্থাৎ তাদের আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী নীতি কতদূর অগ্রসর হবে। এসব কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এবং সংসদের বাইরে দলীয় অনুষ্ঠানে আমেরিকা বিষয়ে শক্ত ভাষায় কথা বলেছেন বলে মনে করেন অনেকে। আবার কেন আমেরিকার সাথে হঠাৎ বিরোধ তৈরি হলো সে প্রশ্নও আছে দলের অনেকের মধ্যে।

দলের নেতারা বলছেন, চীনের সঙ্গে ‘অতিরিক্ত মাখামাখি’ আর কিছু বিষয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্য রুখতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির মাধ্যমে যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে তার সাথে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের গত কয়েক বছরের সম্পর্ক ‘সাযুজ্যপূর্ণ’ নয় বলেই মনে করে দেশটি।

মূলত এসব বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণেই আমেরিকা নির্বাচন নিয়ে এতটা সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। বাংলাদেশ এখন নিজে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া শুরু করেছে। যেটা ভারতও করে। কিন্তু ভারত বড় দেশ তাই তাদের কিছু বলা যায় না। বাংলাদেশ ছোট বলে অনেকে মনে করে বাংলাদেশকে নিয়ে খেলা যায়, বলছিলেন আব্দুর রাজ্জাক।

তবে তিনিসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সাথে আলাপ করে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা হলো আমেরিকাকে ঘিরে দলের মধ্যকার উদ্বেগ মাঠ পর্যায়ে জনমনেও প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে বিবেচনায় নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগ বিভিন্নভাবে উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের জায়গাগুলো প্রশমিত করতে। তবে একটি সংগঠনের বিষয়ে আমেরিকার প্রতিনিধিরা জোর করতে চাইছে। যদিও ওই সংগঠনটিই বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমের সূতিকাগার, বলছিলেন দলটির সিনিয়র পর্যায়ের একজন নেতা।
বিএনপি উজ্জীবিত, স্বস্তি দলের প্রতিটি স্তরে: ঢাকায় বিএনপির সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মী মিজানুর রহমান বশির।

কথা প্রসঙ্গে বিবিসিকে বলেন, আমেরিকা এবার আর সরকারকে ছাড়বে না। নির্বাচন ঠিক মতো না করে যাবে কই সরকার। অর্থাৎ আমেরিকার চাপেই সরকার ক্ষমতা থেকে সরে যাবে এবং দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের যে দাবি বিএনপির শেষ পর্যন্ত সেটি অর্জিত হতে যাচ্ছে- এমনটাই বিশ্বাস করেন এখন বিএনপির অনেক নেতাকর্মী। এমন চিন্তার কারণ হলো, তারা মনে করেন র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও পরে ভিসানীতি ঘোষণার পর থেকেই মূলত নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলছেন, তারা ভোটাধিকারসহ যেসব দাবিতে আন্দোলন করছেন তার সাথে আমেরিকাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান বিশেষ করে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো মিলে গেছে। এটা তো স্বাভাবিক যে বিষয়টি সবাইকে চাঙ্গা করবে। আমরা আন্দোলন করে জনমত তৈরি করেছি। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও একই দাবিগুলো তুলছে। স্বাভাবিকভাবেই এটি আমাদের নেতাকর্মীদের সাহস যুগিয়েছে, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

আমীর খসরু বলেন, বিএনপি বা আন্দোলনরত দলগুলো ছাড়াও সিভিল সোসাইটিও একই ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলছে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও যখন একই ইস্যুতে যৌক্তিক অবস্থান নেয় সেটি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সবাইকে উজ্জীবিত করে। দলের মধ্যম পর্যায়ের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞার পর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি আসায় দলের মাঠ পর্যায়ে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, কোনো কারণে আমেরিকা আর বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে দিতে রাজি নয়।

তাদের বিশ্বাস, এর আগে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে কোনো শক্ত অবস্থান না নিলেও এবার নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই নির্বাচনকেন্দ্রিক শক্ত অবস্থান নেয়ার মূল কারণ এটিই। আবার দলটির প্রায় সব পর্যায়ে ভারত শেষ পর্যন্ত কী করে- এমন একটি উদ্বেগ আছে। তবে তারা মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র শক্ত অবস্থান নিলে কোনো সরকারের পক্ষেই সেটিকে ‘ইগনোর’ করা অসম্ভব’, বলছিলেন দলের মধ্যম সারির একজন নেতা।

একদিকে উদ্বেগ, অন্যদিকে স্বস্তি: অনেকেই মনে করেন, মূলত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাবের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকেই বাংলাদেশর রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলছেন, আমেরিকা গত বেশ কিছুদিন ধরে দৃশ্যমান যে অবস্থান প্রদর্শন করেছে সেটা সরকারি দলের মধ্যে বেশ অস্বস্তি তৈরি করেছে আর বিএনপির মধ্যে এক ধরনের আনন্দ তৈরি করেছে। এখন দেখার বিষয় হবে, এ পরিস্থিতি নির্বাচন পর্যন্ত সময়ে গিয়ে কোন দিকে গড়ায়। তবে সরকারের মধ্যেও সামাল দেয়ার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আবার বিরোধীরাও চাইছেন সরকার আরও চাপে পড়ুক। অর্থাৎ আমেরিকাকে ঘিরে হঠাৎ করেই পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে গেছে, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

যদিও শুধু রাজনৈতিক দল নয় সিভিল সোসাইটির যে অংশটি ২০০৭ সালের রাজনৈতিক সংকটের সময় পশ্চিমাদের অবস্থানকে সমর্থন করেছিল তাদের অনেকেও এখন সরকারের কঠোর সমালোচনা করছেন।

মজুমদার বলছেন, আমেরিকা যখন কোথাও একটা অবস্থান নেয় তখন রাজনৈতিক শক্তির বাইরে আরও অনেক গোষ্ঠীই একই সুরে কথা বলে, যার মূল উদ্দেশ্যই থাকে আমেরিকা যার বিপক্ষে থাকে -তাকে আরও চাপে ফেলা।

‘মূলত এসব কারণেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। আবার এটিই বিরোধী দলগুলোকে স্বস্তি দিচ্ছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র কী করছে- সেটা সাধারণ জনগোষ্ঠীকেও প্রভাবিত করে বা বার্তা দিয়ে থাকে। এখানেও তাই হচ্ছে। এভাবেই রাজনীতির মূল প্রভাবক হয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ বা অবস্থান,’ বলছিলেন তিনি। সূত্র: বিবিসি বাংলা

জাতীয় রাজনীতি শীর্ষ সংবাদ