আয় বাড়েনি বেড়েছে নাভিশ্বাস

আয় বাড়েনি বেড়েছে নাভিশ্বাস

নানা অজুহাতে নিত্যপণ্যের বাজারে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছেই। এই পাগলা ঘোড়া কোথায় গিয়ে থামবে, কে থামাবে, তা জানতে চায় সাধারণ মানুষ। মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে প্রতিনিয়ত। জিনিসপত্রের হু হু করে বাড়লেও বাড়েনি মানুষের আয়। সামপ্রতিক সময়ে তেল ও চিনির মূল্য পাঁচ টাকা কমলেও গ্রাহক পাচ্ছেন না ন্যায্যমূল্যে।

এদিকে দফায় দফায় বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। এর সঙ্গে থেমে নেই চাল, আটা, ময়দা, ডাল, আলু, আদা, রসুন, ডিম, মুরগি, মাছ, লবণ, মাংস ও শাক-সবজির দাম। প্রতিদিনই দাম বাড়ায় উদ্বেগে ফেলছে ক্রেতাদের। আগে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছিল, তা কমারও কোনো লক্ষণ নেই। আবার সরকারের বেঁধে দেয়া দামও মানা হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বমুখী চাপে চিড়েচ্যাপটা হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। পরিবারের ন্যূনতম আমিষের জোগানও নেই অনেক পরিবারে। সপ্তাহান্তেও মাছ-মাংসের দেখা মেলে না নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের। পাঁচশ টাকার বাজারে ব্যাগের অর্ধেকও পোরে না। নিম্নবিত্তের মানুষ দৈনিক বাজার করতে এসে যদি ৫৫ টাকা দামের তিন কেজি চাল কেনেন, তাহলে ১৬৫ টাকা, আধা কেজি ডাল ৬০ টাকা, আধা লিটার তেল ৯৫ টাকা, আলু এক কেজি ৪৫ টাকা, এক হালি ডিম ৫৫ টাকা, আধা কেজি পেঁয়াজ ৬০ টাকা, ১০০ গ্রাম কাঁচামরিচ ২৫ টাকা খরচ হয়। মাছ-মাংসের কথা তো তারা চিন্তাও করতে পারেন না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান বাজার পরিস্থির মূল কারণ মূল্যস্ফীতি। আর এর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। তারা বলছেন, এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আরও কঠিন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের জীবন। রাজধানীতে কয়েকজন সাধারণ মানুষের কথা হয়। তারা জানান, খুব টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাদের সংসার। সঞ্চয় ভেঙে ধারদেনায় সংসার চালাচ্ছেন তারা।

 

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে জানা যায়, দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা কেজিতে। মহল্লার কোনো কোনো দোকানদার ১০০ টাকাও রাখছেন। আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। এদিকে মাস দেড়েক আগে ১২০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে ছিল রসুনের দাম। সেটি বাড়তে বাড়তে ২৫০ টাকায় এসেছে। গত দুই থেকে তিন দিনের ব্যবধানেই আমদানি করা রসুনের কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৫০ টাকায়। দেশি রসুন কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে আদাও। কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়ে ইন্দোনেশিয়ান আদা ২৫০ থেকে ২৬০ এবং মিয়ানমারের আদা ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে দাম কমার পর প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭৪ টাকায়। খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১৫৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা চিনি প্রতি কেজি ১৩০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির কেজি ১৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাজারে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায় খোলা চিনি পাওয়া গেলেও প্যাকেটজাত চিনি পাওয়া যাচ্ছে না।

কাঁচাবাজারের দামের কথা বলাই বাহুল্য। বাজারে ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বেশির ভাগ সবজি। প্রতি কেজি পটোল, চিচিঙ্গা, ছোট শসা, জালি কুমড়া এবং কাকরোল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। ঝিঙা, বরবটি, রান্না করার শসা, কচুর মুখী, করলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। গোল বেগুন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। কাঁচামরিচ প্রতি কেজি ২০০ টাকায় এবং টমেটো ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। মাংসের বাজারের চিত্রও অভিন্ন। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। সোনালি মুরগি ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি মুরগি কিনতে কেজিতে খরচ ৫৫০ থেকে ৭০০ টাকা। গরু ও খাসির মাংস আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। মাছের বাজারেও নেই সুখবর। বাজারে বেড়েছে ইলিশের সরবরাহ তবে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে এখনো। ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ইলিশের কেজি এক হাজার টাকারও বেশি। আর এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকায়। প্রতি কেজি রুই ও কাতলা মাছ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। তেলাপিয়ার কেজি ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা, পাঙ্গাস ২২০ থেকে ২৪০ টাকা, চাষের কই ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা রাহেলা বেগম। অসুস্থ স্বামী কোনো কাজ করতে পারেন না। দুই মেয়েসহ চার জনের পরিবারের যাবতীয় খরচ আঞ্জাম দেন রাহেলা বেগম। তিনি দুই বাসায় ঝিয়ের কাজ করে যা পান তা দিয়েই টেনেটুনে চলছে সংসার। বাজারের দ্রব্যমূল্য বাড়ায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে কেনাকাটায়। তিনি বলেন, আগে মাঝে মধ্যে পাঙ্গাস ও ব্রয়লার মুরগি কিনতে পারতাম, এখন তাও সম্ভব নয়। গরিবের আমিষ খ্যাত ব্রয়লার পাঙ্গাসের কেজি এখন ২৪০-২৬০ টাকা। সাব্বির রহমান বাসাবো এলাকায় ফুটপাতে আটার রুটি, সবজি, ডিম ভাজি বেচেন। রিকশাচালক, আশপাশের আড়তের শ্রমিকরা তার খরিদ্দার। গতকাল সকালে যখন দোকান খোলেন, তখন ঝুড়িতে ২০টি ডিম ছিল। সারা দিনে ১৪টি ডিম ভাজি বিক্রি হয়েছে।

সাব্বির জানান, তার দোকানের কাস্টমাররা গরিব। ২৫ টাকায় ডিম ভাজা খাওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। তাই বিক্রি কমেছে।
মতিঝিলের একটি অফিসে চাকরি করেন মামুন হোসেন। তিনি একটি বেসকররি কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, বেতন ২৫ হাজার টাকা পাই। কিন্তু হিসাবের যেন কুলকিনারা মিলছে না। আগে এক হাজার টাকায় যে পরিমাণ পণ্য পাওয়া যেত এখন তার অর্ধেকও পাওয়া যায় না। যাত্রাবাড়ী এলাকার মতিন মিয়া বলেন, রিকশা চালিয়ে যা পাই নিজের অল্প খরচ রেখে বাকি টাকা গ্রামে পাঠিয়ে দেই। আগে তিন বেলা খেতাম ভালোভাবে। এখন খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছি। খাবারেরর যেই দাম…

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক গবেষণা বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন, শিগগিরই সমাধানের লক্ষণ নেই। পাশাপাশি অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে শুধু খাদ্য ব্যয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৯ টাকা। এটি ‘কমেপ্রামাইজড ডায়েট’ বা আপসের খাদ্য তালিকা। সংস্থাটি আরও বলছে, বিশ্ব মহামন্দায় বাংলাদেশকে সাতটি সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেগুলো হলো— ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি সংকট, খাদ্য সংকট, ইউক্রেন সংকট, কোভিড ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট।

সাধারণ নাগরিক সামাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দীন আহমেদ  বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই বাজার ঊর্ধ্বমুখী। সরকার, ভোক্তা অধিকার, ব্যবসায়ী কেউ-ই বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মূলত ট্যারিফ কমিশনের কাজ বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু তা না করে ব্যবসায়ীরা খাদ্য বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যে প্রস্তাব দেয় তাই কার্যকর হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের কাছে জবাবদিহিতা না থাকায় দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে এখন পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। সরকার স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বললেও বাজার ব্যবস্থায় স্মার্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে।’

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলাম বলেন, ‘আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতিতে জনগণ অসহায় হয়ে পড়েছে। এর একটি প্রভাব ইতোমধ্যে জনজীবনে পড়েছে এবং সেটি অবশ্যই আরও বাড়বে। যেমন— সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। ভোগ ব্যয় কমবে এবং ভোগ্য পণ্য কম ব্যবহার করে তারা বঞ্চিত হবে। জীবনযাত্রার মান কমে যাবে।’

অর্থ বাণিজ্য শীর্ষ সংবাদ