বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশেকে দেয়া ঋণের অন্যতম শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএমফ) রিজার্ভের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিল। সে অনুযায়ী, আগামী সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ থাকতে হবে ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ আরও কমে ২১ বিলিয়নের ঘরে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কারণ এ মাসেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় পরিশোধ করতে হবে। নির্ধারিত পরিমাণ রিজার্ভ মজুত করতে ব্যর্থ হওয়ায় আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করবে কি-না তা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। একই সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের ক্রেডিট লাইন কমে যাওয়াসহ নানামুখী সমস্যা দেখা দিচ্ছে। রিজার্ভ ধরে রাখতে গিয়ে নির্ধারিত সময়ে বকেয়া পরিশোধ না করায় বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে ডিমেরিট দিচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য দিন দিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। অন্যদিকে দেশের অন্যসব আর্থিক সূচকে এগিয়ে থাকলেও রিজার্ভের অপর্যাপ্ততার কারণেই ব্রিকস জোটে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে রিজার্ভ নিয়ে আরও বড় সমস্যা তৈরি হতে পারে।
ঋণ চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে আইএমএফের বিভিন্ন শর্ত মেনে চলছে সরকার। সংস্থাটির পরিমাণগত কর্মক্ষমতা মানদণ্ড অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চলতি বছরের জুনে ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে থাকতে পারবে না। অথচ বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে ২৩ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তা ২১ বিলিয়নের ঘরে নেমে যাবে। কারণ আগামী মাসে আকু পেমেন্ট বাবদ এক বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। গত বছর আকু পেমেন্ট দুই বিলিয়নের কাছাকাছি থাকলেও আমদানি কমে যাওয়ায় বিগত কয়েক কিস্তিতে আকু পেমেন্ট সোয়া বিলিয়নের আশেপাশে থাকছে। দুই মাস পরপর এশিয়ার দেশগুলোকে এ দায় পরিশোধ করতে হয়। সর্বশেষ গত ৬ জুলাই মে-জুন মাসের দায় বাবদ ১১০ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত প্রতি মাসেই কমছে। কারণ যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ হচ্ছে, ব্যয় হচ্ছে তার চেয়েও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের ২৩ আগস্ট বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল যেখানে তিন হাজার ৯৩৫ কোটি ডলার, চলতি মাসের একই সময়ে তা কমে নেমেছে দুই হাজার ৯৩২ কোটি ডলার। এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমেছে এক হাজার তিন কোটি বা ১০ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের শর্ত পরিপালন করতে প্রকৃত হিসাবের যে তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক দিচ্ছে তাতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত মজুত (গ্রস রিজার্ভ) আরো কমে নেমেছে দুই হাজার ৩১৬ কোটি ডলার। এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে মজুত কমেছে এক হাজার ৬১৯ কোটি বা ১৬ বিলিয়ন ডলার। শুধু বৈদেশিক মুদ্রার মজুতই কমছে না, একই সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৪ দশমিক ২১ শতাংশ। গত বছরের ২৩ আগস্ট এক ডলার পেতে ব্যয় করতে হতো ৯৫ টাকা, সেখানে চলতি বছরের একই সময়ে তার জন্য ব্যয় হচ্ছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। তবে এ হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাস্তবে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন হচ্ছে ১১২ টাকা থেকে ১১৩ টাকা পর্যন্ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি দরে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রের তথ্যমতে, বৈদেশিক মুদ্রার অন্তর্মুখী প্রবাহ কমে যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত হারে রেমিট্যান্স আসছে না। রপ্তানি আয়েও তেমন গতি নেই। কিন্তু বিপরীতে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হচ্ছে তার ব্যয় পরিশোধের পাশাপাশি আমদানির বকেয়া দায়ও পরিশোধ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়েই বৈদেশিক মুদ্রার অন্তঃপ্রবাহের চেয়ে বহিঃপ্রবাহ বেশি। যার প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ২৩ আগস্ট বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত মজুত দুই হাজার ৩১৬ কোটি ডলারে নেমে গেছে। যেখানে জুলাই শেষে ছিল দুই হাজার ৩৩৫ কোটি ডলারে। এ হিসাবে ২৩ দিনে প্রকৃত মজুত কমেছে ১৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রায় প্রতিদিনই কমছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত।
এ দিকে, রিজার্ভ কমে যাওয়ায় ডলার বাজারে যে চাপ তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলা করতে দেশীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এতে বেড়ে যায় পণ্যের আমদানি ব্যয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের ২৩ আগস্ট প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় করতে হতো ৯৫ টাকা, গত ২৩ আগস্ট তার জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। তবে, এ হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাস্তবে এরও বেশি দরে ডলার লেনদেন হচ্ছে। ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলার কেনাবেচায় নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা মানছে না। ব্যাংকারদের সংগঠন যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ডলারে লেনদেন হচ্ছে তার চেয়েও বেশি দরে। রেমিট্যান্স আহরণ করছে ১১২ টাকা দরে। অথচ নিজেদের সিদ্ধান্ত ছিল ১০৮ টাকা। আর বেশি দরে ডলার আহরণ করায় আমদানির ক্ষেত্রে বেশি দরে ডলার কিনতে হচ্ছে। এতে পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে।
অন্যদিকে ডলার বাজারের অস্থিরতা কমাতে এবং জরুরি পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে। এর মাধ্যমে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা আয় করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদসভায় গত অর্থবছরের বার্ষিক এ হিসাব চূড়ান্ত করা হয়। আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) এর অর্ধেক অর্থাৎ সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর গত জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গণমাধ্যমকে জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে কোনো ব্যাংকের কাছে সস্তায় কিংবা স্বাভাবিক দরেও ডলার বিক্রি করা হবে না।
কিন্তু গত বুধবার পর্যন্ত প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার সংকট থাকায় জ্বালানি ও নিত্যপণ্য আমদানি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টের ২৩ দিনে (১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন) ১৯৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। যা দেশের স্বার্থেই করা হয়। আর ডলার পর্যাপ্ত থাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে ব্রাজিল, ভারত, চীন, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত বৈশ্বিক জোট ব্রিকসে নতুন ছয় দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চেষ্টা করেও এ জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আর্থিক এ জোটে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে যেসব সূচক বিবেচনায় নেয়া হয়েছে তার অধিকাংশই বাংলাদেশ পূরণ করেছে। নতুন যে ছয়টি দেশকে এ জোটের সদস্য করা হয়েছে কিংবা যারা আগে থেকেই এ জোটে আছে তাদের কারো কারো থেকে বাংলাদেশে জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বেশি। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পর্যাপ্ততা না থাকায় এ জোটে বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হয়নি। কারণ কোনো দেশের রিজার্ভ স্থির না থাকলে জিডিপি অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ব্যাহত হতে পারে মাথাপিছু আয়ের কাঙ্ক্ষিত হার।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘বাংলাদেশকে ব্রিকসে কেন নেয়নি সে আলোচনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যাদের নিয়েছে তাদের অবস্থান পর্যালোচনা করা। তাদেরকে প্রাধিকার দেয়া হয়েছে; কারণ তাদের সামগ্রিক আর্থিক অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো।’য়।