চলতি একাদশ জাতীয় সংসদের ২৪তম বৈঠক শুরু হচ্ছে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর রবিবার। ঐ দিন বিকাল ৫টায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংসদের এই অধিবেশন ডেকেছেন। এটিই হতে পারে একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন। তবে সেপ্টেম্বরে এই অধিবেশনটি শেষ করে অক্টোবরে আরেকটি অধিবেশন ডাকারও সুযোগ রয়েছে সংবিধান অনুযায়ী।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিল কিংবা কার্যক্রম না থাকলে ২৪তম অধিবেশনটি মাঝে মধ্যে মুলতুবি দিয়ে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত চালানো হতে পারে। এরপর বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নভেম্বরের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে যাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন গণনা।
সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’
চলতি একাদশ সংসদের প্রথম বৈঠক বসেছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সেই হিসাব অনুযায়ী, বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, সংসদ বহাল রেখে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে এর পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যে কারণে, এ বছরের ১ নভেম্বর থেকে সেই ৯০ দিন গণনা শুরু হবে।
নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আনিছুর রহমান গত ৯ আগস্ট সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপসিল নভেম্বরের যে কোনো দিন ঘোষণা করা হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমরা সাধারণত ভোটগ্রহণের দিনের আগে ৪০ থেকে ৪৫ দিন সময় হাতে রেখে তপসিল ঘোষণা করে থাকি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে। এই সময় ধরে যথাসময়ে তপসিল ঘোষণা করা হবে।’
সংসদ
এর আগে গত ২৭ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘কবে তপসিল ঘোষণা করতে হবে, সেটা আইনে উল্লেখ নেই। সেটা ৫০, ৬০ বা ৭০ দিন আগেও হতে পারে।’ অবশ্য সংসদের মেয়াদপূর্তির ৯০ দিনের আগে তপসিল ঘোষণা করা যাবে কি না, তা আইনে স্পষ্ট করে উল্লেখ নেই। যদিও নির্বাচন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, তপসিল ঘোষণা, মানে নির্বাচন শুরু হওয়া। সংসদের মেয়াদপূর্তির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের আগে তপসিল ঘোষণার সুযোগ নেই, অর্থাৎ নভেম্বরের আগে তপসিল ঘোষণা করা যাবে না।
অবশ্য, সংবিধানে এর আগেও নির্বাচন করার সুযোগ আছে। সেক্ষেত্রে মেয়াদপূর্তির আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। সংবিধানে বলা আছে, ‘মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ অর্থাৎ যেদিন সংসদ ভাঙবে, তার পরের ৯০ দিনের মধ্যে ভোট করতে হবে।
সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী, সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভেঙে দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত হলেও রাষ্ট্রপতি তার এ দায়িত্বটি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী পালন করে থাকেন। সংসদের মেয়াদ হলো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান-পরবর্তী প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর; তবে এক্ষেত্রেও মেয়াদপূর্তির আগে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সংসদ ভেঙে দিতে পারেন।
সংবিধানে এ-ও বলা আছে, সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও প্রজাতন্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত থাকাকালে সংসদের আইন দ্বারা এর মেয়াদ এককালে অনধিক এক বছর বৃদ্ধি করা যায়; তবে যুদ্ধ শেষ হলে বর্ধিত মেয়াদ কোনোক্রমে ছয় মাস অতিক্রম করতে পারবে না। আবার সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর এবং সংসদের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে রাষ্ট্রপতির কাছে যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, প্রজাতন্ত্র যে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে, সে যুদ্ধাবস্থার বিদ্যমানতার জন্য সংসদ পুনঃ আহ্বান করা প্রয়োজন, তাহলে যে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি সেটি আহ্বান করবেন। এক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য সম্পন্ন করতে হয়।
জাতীয় সংসদ ভবন। ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় সংসদ ভবন। ছবি: সংগৃহীত
তবে, সংবিধানের এসব বিকল্প নিয়ে সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভাবছে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্পষ্ট করেই বলেছেন—সংসদ ভাঙবে না, সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদপূর্তির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সংবিধান মোতাবেক সংসদের একটি অধিবেশন শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে পরবর্তী অধিবেশন ডাকার বাধ্যবাধকতা আছে। গত ৬ জুলাই বাজেট অধিবেশন কিংবা চলতি একাদশ সংসদের ২৩তম অধিবেশন শেষ হয়। সংবিধান অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে ২৪তম অধিবেশন ডেকেছেন রাষ্ট্রপতি, যা আগামী ৩ সেপ্টেম্বর শুরু হতে যাচ্ছে।
সংবিধানে বলা আছে, ‘একটি অধিবেশন শেষ হওয়ার দিন এবং পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ৬০ দিনের বেশি বিরতি দেওয়া যাবে না।’ তবে এই বিধান সংসদের মেয়াদপূর্তির আগের ৯০ দিনের (পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সে হিসাবে আসন্ন ২৪তম অধিবেশনের পর আর সংসদের অধিবেশন না ডাকলেও চলবে। সেক্ষেত্রে এটিই হবে চলতি সংসদের শেষ অধিবেশন।
সংবিধানের এই সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ৭২(১) এ বলা হয়েছে, ‘সরকারী বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাষ্ট্রপতি সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ্গ করিবেন এবং সংসদ আহ্বানকালে রাষ্ট্রপতি প্রথম বৈঠকের সময় ও স্থান নির্ধারণ করিবেন: তবে শর্ত থাকে যে, ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩) দফার (ক) উপ-দফায় উল্লিখিত নব্বই দিন সময় ব্যতীত অন্য সময়ে] সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ষাট দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকিবে না।’
জাতীয় সংসদ ভবন
প্রসঙ্গত, বিগত দশম সংসদের শেষ বৈঠক বসে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর। ঐ বছরের ৮ নভেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের তপসিল ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন এবং ৩০ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ হয়।
সংসদ সচিবালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বিল পাশে রেকর্ড গড়ে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর শেষ হয় দশম সংসদের সর্বশেষ বৈঠক, যা ছিল ঐ সংসদের ২৩তম অধিবেশন। মাত্র আট কার্যদিবসের সর্বশেষ ঐ অধিবেশনে ১৯টি বিল পাশ হয়েছিল। এছাড়া ঐ অধিবেশনে ডজনখানেক বিলের রিপোর্ট উপস্থাপিত হয়। সব মিলিয়ে ঐ অধিবেশনে বিল পাশের হুড়োহুড়ি লক্ষ করা গেছে। কোনো কোনো বিল সংসদে উত্থাপনের পর মাত্র ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির রিপোর্টের জন্য সময় দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া প্রায় প্রতিদিন রাতে সম্পূরক কার্যসূচি এনে বিলের রিপোর্ট উপস্থাপন এবং বিল পাশ হতেও দেখা গেছে। সংসদ অধিবেশন মুলতুবি হওয়ার পর রাত ১১টায় স্থায়ী কমিটির বৈঠক বসার ঘটনাও ঘটেছিল তখন