নিজস্ব প্রতিবেদক
মানিলন্ডারিং মামলায় নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সমন জারির পর হঠাৎ রাজনীতিতে আলোচনায় এ অর্থনীতিবিদ। গত সোমবার ১০০ নোবেল বিজয়ীসহ শীর্ষ ১৬০ ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচার স্থগিত, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলাচিঠি দিয়েছেন।
চিঠিতে তারা বলেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের মামলায় আমরা উদ্বিগ্ন। সমপ্রতি তাকে টার্গেট করা হয়েছে। এটা ক্রমাগত বিচারিক হয়রানি বলেই আমাদের বিশ্বাস। তা বন্ধ করার জন্য অনুরোধ রইল।
একদিন পর এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্দোষ হলে বিবৃতি ভিক্ষা করতে যেতেন না। বিবৃতিদাতারা বাংলাদেশে এসে ড. ইউনূসের কাগজপত্র পরীক্ষা করুক, তখন দেখা যাবে তিনি কতটা নির্দোষ। বিদেশে কারো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আদালত স্বাধীন তাই স্বাধীনভাবে কাজ করবে। পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, শত বছর পরও জাতি লজ্জিত হবে ড. ইউনূসের বিষয়ে সরকারের আচরণ নিয়ে। গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া বলেছেন, আমরা হতবাক ও লজ্জিত। সরকারকে আহ্বান জানাবো ড. ইউনূসকে হেনস্তা, মামলাবাজি বন্ধ করুন।
এদিকে সরকারপন্থি অন্যান্যের মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম অভিযোগ তুলে বলেছেন, ড. ইউনূস এবং তার বন্ধুরা এখনও অর্থ খরচ করে বাংলাদেশকে নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মো. খুরশিদ আলম বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্ব নেতাদের দেয়া ১০০ নোবেলজয়ীর বিবৃতি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ। তিনি বলেন, বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের আইন, বিচার বিভাগকে না জেনে, পর্যালোচনা না করে অযাচিতভাবে বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করছেন।
এ ইস্যুতে রাজনীতিবিদরা মনে করছেন, রাজনীতিতে ড. ইউনূস এখন টার্নিং পয়েন্টে রয়েছেন। তাকে নিয়ে অনেক কূটনৈতিক হিসাব করছেন। একদিন পার হলেই শোকের মাস বিদায়। যাত্রা শুরু হবে সেপ্টেম্বরে। এ মাসেই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি হতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ে জাতীয় নির্বাচন হবে নাকি অন্যকিছু ঘটতে যাচ্ছে। যদি নির্বাচন না হয় তাহলে কোন ফর্মেটে যাচ্ছে দেশ— এ বিষয়টি সেপ্টেম্বরে নির্ধারিত হতে যাচ্ছে। এরপর অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে তা নতুন যাত্রা হতে পারে বলেই অনুমান করছেন অনেকে।
১৭৫ জন বিশ্বনেতা ও নোবেলজয়ীর চিঠির বিষয়ে সরকার বিচলিত নয় বা কোনো চাপে নেই বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে কোরিয়ান দূতাবাস আয়োজিত কোরিয়া-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ক সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দণ্ড দেয়া হতে পারে— এমন আশঙ্কায় ১০০ জনেরও বেশি নোবেলজয়ীসহ ১৭৫ জন বিশ্বনেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তবাকের বিশ্বে যেকোনো অবস্থান থেকে যে কেউ যেকোনো কিছু বলতে পারে এবং আউট অফ দ্য ওয়ে যেভাবে বলি না কেন এখানে সরকারের কোনো প্রভাব ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন। স্বাধীন বিচার বিভাগ যেটা মনে করেন, তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সেটাই করবেন। একটি বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করার আহ্বান দ্যাটস আন হাড অফ।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না যারা এই আবেদনে শামিল হচ্ছেন তারা তাদের রেপুটেশনের প্রপার জাস্টিস করছেন। একটা বিচারকে তারা অবজারভ করতে পারেন কিন্তু একজন ব্যক্তি যিনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত যিনি শত শত হাজার মানুষকে নিয়োগ করেছেন, যার প্রপার্টি আছে তার তো একটা লিগ্যাল ইস্যু থাকতে পারে। তার মানে এই না সে অপরাধী হয়েই যাবে আর সেটা ইনভেস্টিগেট করাই যাবে না। পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি কি আছেন যার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা তদন্ত করা যাবে না বা কোর্টে নেয়া যাবে না?’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এটা হতাশাজনক যে একজনকে অব্যাহতভাবে প্রটেকশান দেয়ার জন্য, কিন্তু আমরা বুঝতে পারি। অতীতেও কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মর্যাদা শুধু তার গুণের কারণে হয়েছে তা নয়। এর পেছনে অনেক বিনিয়োগ আছে। আমি ওদিকে যেতে চাই না। আর এটা সরকারের বক্তব্য নয়, আমার নিজের বক্তব্য। কিন্তু নো মেটার হোয়াট বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচার বিভাগই সিদ্ধান্ত নেবে এবং বিচার চলবে। আমরা এটা নিয়ে বিচলিত বা এটা নিয়ে চিন্তিত বা চাপে নেই।’
ড. ইউনুসের সঙ্গে সরকারের কোনো দূরত্ব বা এজেন্ডা আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা ১/১১-এর ঘটনা প্রবাহ জানেন। তারপর গত ১৫ থেকে ১৭ বছরের আমাদের দিক থেকে কিছু নেই। কিন্তু আমরা যেটা দেখেছি, যেটার প্রতিফলন আপনারা আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমে দুই পাতা ভাড়া করতে অন্তত পক্ষে মিলিয়ন ডলার লাগে। সেই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে একটা পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মতো স্বাক্ষর নিয়ে, যে স্বাক্ষরের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত। তিনি বা তার লোকজন এখনো অর্থ বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এ মামলার সঙ্গে এটার কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘এরা বাংলাদেশের বন্ধু, তাদের কাছে ভুল মেসেজ যাচ্ছে। একটা বিষয়ে বলি, আমরা যেসব কনট্রাকসের কাছে পৌঁছালে তারা আমাদের কথাটা শোনার সম্ভাবনা আছে আমরা যেমন বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্ধের কাছে অতীতে করেছি, এখনো আমাদের দূতাবাসগুলো করে যাচ্ছে। আমরা তাদের কাছে এটার যতটুকু জানি তুলে ধরব। একটা বিচারাধীন বিষয়ে সরকার বা আমাদের দূতাবাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন করে ব্যাখ্যা বা বলার কিছু নেই। কারণ আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তেতে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাদের এ অনুরোধটুকু করব এবং রিএসুয়েন্সটুকু দেব, বিচারব্যবস্থা স্বাধীন। নাথিং টু ওরিড। দে হ্যাভ মাস্ট গার্ডস অ্যান্ড কারেজ এক্সসেপ্ট দ্য ভারডিক্ট অফ।’
অপরদিকে ড. মুহম্মদ ইউনূসের পক্ষে শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ ১৭৫ জনেরও বেশি বিশ্বনেতার বিবৃতিকে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম। এ সময় বিশ্বনেতাদের বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে দুদক আইনজীবী আদালতে এসে নোবেলজয়ীদের বিচার পর্যবেক্ষণের আহ্বান জানান। গতকাল মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে এনেক্স ভবনের সামনে সাংবাদিকদের কাছে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, বিশ্ব নেতারা বাংলাদেশের আইন, বিচার বিভাগকে না জেনে, পর্যালোচনা না করে অযাচিতভাবে বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করছেন। তারা আদালতে ড. ইউনূসের মামলা নিয়ে এত মাতামাতি করছেন কেন আমার বুঝে আসে না। বিশ্বনেতাদের বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে খুরশীদ আলম খান বলেন, বাংলাদেশে আসুন, দেখুন কত স্বচ্ছতার সাথে ড. ইউনূসের মামলার বিচারকাজ চলছে। শুধু ড. ইউনূসের কথায় বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নিয়ে বিরূপ ধারণা পোষণ করবেন না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস হলেন এই জাতির একজন সূর্যসন্তান। উনাকে যারা ছোট করতে চান, অপমান করতে চান, তারা আরেকবার জন্ম নিলেও উনার সমান উচ্চতায় যেতে পারবেন না। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘শত বছর পরও এই জাতির মানুষ ড. ইউনূসকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে এবং লজ্জিত হবে এই ভেবে যে, এ রকম বরেণ্য একজন মানুষের সাথে এই দেশের সরকার কী রকম নিচু আচরণ করেছিল। উনার বিরুদ্ধে সব মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। উনি এই দেশের একজন কীর্তিমান ব্যক্তি। এই অনিবার্য সত্যটা মেনে নিয়ে উনাকে হেনস্তা করা বন্ধ করুন। এসব মামলাবাজি বন্ধ করার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস হলেন এই মাটির বিশ্ববরেণ্য সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তার বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মেনে নেয়া হবে না। ড. মোহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে সারাবিশ্বে তুলে ধরেছেন, দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন, দেশের জন্য খ্যাতি সম্মান বয়ে আনছেন, আর ওনাকে প্রতিনিয়ত অপমাণিত করছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। সরকারের আদালতকে ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে আর্থিক অস্বচ্ছতা বিষয়ে আনীত মিথ্যা অভিযোগের ব্যাপারে জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত, বিরক্ত এবং হতবাক।
রেজা কিবরিয়া বলেন, কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, সরকারের ছত্রছায়ায় এস আলম গ্রুপ দেশ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। বেক্সিমকো গ্রুপ বিশেষ বিবেচনায় ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিয়ে দেশের অর্থনীতি ধসিয়ে দিয়েছে, অথচ এসবের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত নাই, বিচার নাই, দোষীদের গ্রেপ্তার নাই। আর এসব লুটপাটের সব ব্যাপারেই দেশের আদালত অবগত আছে বলে আমরা দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি, কিন্তু এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এবং সরকারের ইচ্ছায় আদালত কোনো ব্যবস্থা নিবেও না। এ রকম একজন বিখ্যাত সজ্জন ব্যক্তিকে হেনস্তা করা বন্ধ করুন, মামলাবাজি বন্ধ করুন, অন্যথায় গণঅধিকার পরিষদ দেশবাসীকে সাথে নিয়ে ড. ইউনূসের সম্মান রক্ষায় দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেন ড. রেজা কিবরিয়া।
উল্লেখ্য, শ্রমিকদের পাওনা মুনাফার টাকা না দিয়ে মানিলন্ডারিং করে টাকা সরিয়ে নিচ্ছেন নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস— এমন অভিযোগ এনে শ্রম আদালতে ১৮ শ্রমিকের মামলায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন আদালত। গত সোমবার সকালে ১৮ শ্রমিক তাদের পাওনা মুনাফার দাবি নিয়ে ঢাকার শ্রম আদালতে এ মামলা দায়ের করেন। পরে শুনানি শেষে বিচারক এ আদেশ দেন। এর আগের করা আরেকটি মামলার বিচারকাজ ঢাকা শ্রম আদালত-৩-এ বিচারাধীন রয়েছে।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনে যান। সেখানে গিয়ে তারা শ্রম আইনের কিছু লঙ্ঘন দেখতে পান। এর মধ্যে ১০১ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে স্থায়ী করার কথা থাকলেও তাদের স্থায়ী করা হয়নি। শ্রমিকদের অংশগ্রহণের তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি। এ ছাড়া কোম্পানির লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে এ মামলা করা হয়।