সরকার যখন আমদানি ব্যয়ের রাশ টেনে ডলার খরচে কৃচ্ছ্রসাধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সুযোগে ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহল দ্রব্য মূল্যের দাম বাড়াচ্ছে। যে কারণে সরকারের কঠোর মনিটরিংয়ের পরও একেক সময় একেক পণ্যের দাম বাড়িয়ে মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, মূলত দেশে ডলার সংকটের কারণে নতুন আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) কমছে। এ কারণে আমদানি সীমিত হওয়ায় সিডিন্ডকেট ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে। ডিম, ব্রয়লার মুরগি, পেঁয়াজ, চিনি, সয়াবিন তেল, আটা-ময়দা এমনকি কাঁচা মরিচের মতো নিত্য পণ্যেও সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার।
অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টদের মতে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ডলারের সংকট পুরোপুরি মিটে যাবে। ইতোমধ্যেই ব্যাংকগুলোতে ডলার ধারণের হার বেড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া অধিকাংশ ব্যাংকের সক্ষমতা বেড়েছে। তবে পুরোপুরি মিটেনি। তাই ব্যবসায়ীদের আরও সততা নিয়ে কাজ করতে হবে। অন্যথায় বাজারের অস্থিতিশীলতা কমবে না।
তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের গোড়া থেকেই দেশে আমদানি কমছে। গত জুলাইয়ে নতুন আমদানির এলসি কমেছে ৩১ শতাংশেরও বেশি। একই সময়ে আমদানির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ২০ শতাংশ। আমদানির লাগাম টেনে ধরার কারণেই বাজারে ডলার সংকটের তীব্রতা কিছুটা কমেছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেও আমদানির জন্য ঋণপত্রের (এলসি) দায় মেটাতে ব্যাংকগুলোকে এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। এতে দিন যত যাচ্ছে কমছে রিজার্ভ। আগস্টের প্রথম ২৩ দিনেই রিজার্ভের পরিমাণ কমেছে ১৯ কোটি ডলার।
এর আগে গত ১৩ জুলাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ফর্মুলা অনুযায়ী দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হাঠৎ করেই ৩০ বিলিয়ন থেকে সাড়ে ২৩ বিলিয়নে নেমে আসে।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন বা বিপিএম-৬ পদ্ধতি মেনে রিজার্ভ হিসাব করার শর্তে ৪.৭ বিলিয়ন ঋণ অনুমোদন দিয়েছিল।
আইএমএফের সেই ফর্মুলা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হলো ২৩ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এর আগের দিন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ বিলিয়ন ডলারের উপরেই।
আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অন্যতম শর্তানুযায়ী বিপিএম-৬ মডেল অনুযায়ী জুনের মধ্যে রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করার কথা ছিল। বর্তমানে যে পরিমাণ রিজার্ভ আছে অর্থাৎ ২৩ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের ৪ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান।
যদিও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সামাল দিতে খরচ কমানোর জন্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপসহ নানা পদক্ষেপ এরই মধ্যে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারের বিপরীতে কয়েকটি দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে।
সর্বশেষ গত ১১ জুলাই ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেন চালু করা হয়েছে। এছাড়াও রাশিয়া ও চীনের মুদ্রায় লেনদেনে প্রস্তাব রয়েছে। ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য হলে বছরে অন্তত দুই বিলিয়ন ডলার কম খরচ হবে বলে জানিয়েছে। ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে।
এদিকে আমদানিতে কঠোরতা আরোপ করা সত্ত্বেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
বিগত অর্থবছরে (জুলাই-জুন) বাংলাদেশ ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এ সময়ের মধ্যে ৫২ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।
২০২৩ অর্থবছরে আমদানি কমেছে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যেখানে রপ্তানি বেড়েছে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ায় বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আশানুরূপ হচ্ছে না, বৈদেশিক বিনিয়োগ কমছে, এর প্রভাবে বাণিজ্য ঘাটতির মধ্যে পড়ছে বাংলাদেশ।
২০২৩ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি সামগ্রিক বাণিজ্য ভারসাম্যে একটি বড় ব্যবধান তৈরি করেছে। এ ঘাটতির পরিমাণ ৮ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সামগ্রিক চলতি হিসাবে ঘাটতি বৃদ্ধির কারণ হলো- বিভিন্ন উৎস থেকে দেশে আসা বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ, যা পরিশোধ করা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন বিক্রি করেছে। আগের অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এভাবে ডলার বিক্রির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। আর এই সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় কারসাজি চালিয়ে যাচ্ছে। পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিরিক্ত দাম নেওয়া হচ্ছে। এতে সাধারণ ভোক্তারা নিরূপায় হয়েই অতিরিক্ত দাম দিয়ে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া বলেন, বাংলাদেশের বাজারে ৮০ শতাংশ ব্যবসায়ী অসৎ। ব্যবসায়ীদের কারণে বাজারে গিয়ে মানুষ কোনো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছে না। যদি ভোক্তারা মরে যায়, তাহলে আপনাদের ব্যবসা থাকবে না। সব ক্ষেত্রে অরাজকতা চলছে, এভাবে অরাজকতা চলতে দেওয়া যায় না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার বাজার পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেকোনো দেশের অর্থনীতিতেই কিছুটা শঙ্কা ও উদ্বেগ থাকে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। তবে দেশের রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স ইতিবাচক ধারায় আছে। তাই ডলারের সংকট বেশি দীর্ঘায়িত হবে না।