বড় সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট। পুরো অর্থনীতিতে টানাপোড়েন চলছে। ক্রমেই রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক সংকট বড় হচ্ছে। এসব নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে আগামী দিনে এটি আরও বেশি বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। আর এ সংকটের জন্য বড় অংশ দায়ী দেশ থেকে অর্থ পাচার, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেট। এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলেই এই সংকট এড়ানো যেত। দি এশিয়া ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক সমীক্ষা নিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা এসব কথা বলেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে মঙ্গলবার এক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে দি এশিয়া ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)। ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৬৪টি জেলার ১০ হাজার ২৪০ জন নারী-পুরুষ অংশ নেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭০ শতাংশ মনে করে, অর্থনীতি ভুলদিকে চলছে। আর ২৫ শতাংশ মানুষ মনে করে, অর্থনীতি সঠিক পথে চলছে। অপরদিকে ৪৮ শতাংশ মানুষ মনে করে, ভুল পথে চলছে রাজনীতি। ৩৯ শতাংশ মানুষ মনে করে, রাজনীতি সঠিক পথে চলছে। অর্থনৈতিক অবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের নেতিবাচক ধারণা ক্রমেই বাড়ছে। ৮৪ শতাংশ মানুষ জানিয়েছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের জীবন ও জীবিকার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ব্যবসায়িক মন্দা, বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রভৃতি সমস্যার কথাও জরিপে উঠে এসেছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকার ভুল পথে কি না, জানি না। তবে বর্তমান সরকারের সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো মূল্যস্ফীতি। জিনিসপত্রের দাম এমনভাবে বাড়ছে, তাতে সাধারণ মানুষের টিকে থাকা কঠিন। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ রেমিট্যান্স বাড়ছে না। প্রতিবছর বিদেশে অনেক লোক যাচ্ছে, কিন্তু ওইভাবে রেমিট্যান্স আসছে না। তৃতীয় বিষয় হলো রিজার্ভ বাড়ছে না। ক্রমেই কমে আসছে। চতুর্থ বিষয় হলো এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ আরও চ্যালেঞ্জে পড়বে। তিনি বলেন, চাইলে এসব চ্যালেঞ্জ কিছু এড়ানো যেত। তার মতে, অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ভালো নয়। এক্ষেত্রে বড় অংশই দায়ী বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অর্থ পাচার বন্ধ হলে ডলার কিছুটা কমত। কিন্তু এটি বন্ধ করা কঠিন। কারণ, এর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। তবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে গরিব মানুষকে রক্ষা করা যেত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক সংকট বড় হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার ও সিন্ডিকেট-এই তিন কারণে পুরো অর্থনীতি বেসামাল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। বর্তমানে এক মার্কিন ডলার কিনতে ১১৮ টাকার বেশি লাগছে। এটি খুবই উদ্বেগজনক। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে। কিন্তু এসব ঋণ নিয়ে রক্তক্ষরণে কিছুটা প্রলেপ দেওয়া যায়। সমস্যার সমাধান হয় না। কারণ, অর্থনীতিতে সমস্যা বিশাল। এটি সমাধানের দুটি উপায় ছিল। প্রথমত, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানো এবং দ্বিতীয়ত, সিন্ডিকেট ভেঙে মানুষের আস্থা বাড়ানো। এর কোনো কিছু হচ্ছে না। ফলে পরিস্থিতি দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। কারণ, প্রতিবছর দেশে ১০ লাখ টনের বেশি চাল আমদানি করতে হয়। এগুলো ভারত, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম থেকে আসে। আর এসব দেশ ইতোমধ্যে চাল রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়গুলো অত্যন্ত উদ্বেগের। জানি না সরকার কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, বর্তমানে চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি। পুরো অর্থনীতিতে টানাপোড়েন চলছে। মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি-রপ্তানি এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাতসহ সব চলকই বড় ধরনের সমস্যাগ্রস্ত। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই একেক সময় একেক পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেই। এক্ষেত্রে দায়িত্বশীলরা একেবারেই অসহায়। কিন্তু মানুষের ভোগান্তি কীভাবে কমবে, এর কোনো লক্ষণ দেখছি না। সবকিছু মিলে বিষয়গুলো খুবই উদ্বেগের। আর জরিপ রিপোর্টে সেসব উদ্বেগের কথা বলা হয়েছে। মনে হয় না এখানে দ্বিমত পোষণের সুযোগ আছে।