অনেক দাম গরিবের পণ্যের

অনেক দাম গরিবের পণ্যের

বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম শুধু বাড়ছেই। দ্রব্যমূল্যের চড়া বাজারে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত। সেখানে খেই হারিয়ে ফেলছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। বিশেষ করে মোটা চাল, অ্যাংকর ডাল, খোলা সয়াবিন তেল, আলু, ডিম, পাঙ্গাশ মাছের মতো কম দামের পণ্যগুলোর দাম বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র ও খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী এখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে। অর্থাৎ দাম বৃদ্ধির এ প্রবণতায় খাঁড়ার ঘা মড়ার উপরই বেশি পড়েছে। অতি মূল্যস্ফীতির বাজারে কম দামের পণ্য হিসেবে পরিচিত নিত্যপণ্যের দাম এখন আর সস্তা পর্যায়ে নেই। এগুলোও এখন দামি পণ্যে পরিণত হয়েছে, যা বেশিরভাগ গরিবেরই নাগালের বাইরে। ফলে বাজারে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া গরিবের আর কিছুই যেন করার নেই।

গতকাল যাত্রাবাড়ী বাজারে পরিবারের জন্য বাজার করতে এসে একরকম খালি ব্যাগ নিয়েই বাড়ি ফিরছিলেন দিনমজুর মো. সিরাজ উদ্দিন। কথা হলে আক্ষেপ করে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আড়তে বস্তা টাইনা কয় টাকাইবা কামাই। তা দিয়া দামি মাছ খাওনের সামর্থ্য নাই। সস্তায় পাঙ্গাশ পাইতাম। এখন হেইডাও দামি হইয়া গেছে। আলু আগে ১৫-২০ টাকাতেও কিনছি। এখন ৪৫ টাকার নিচে পাওন যায় না। সস্তার কাঁচাকলা, পেঁপের দামেও আগুন। নষ্ট পেঁয়াজের কেজিও ৫৫ টাকা। খোলা তেল আগে ১০-২০ টাকায় পাইতাম। এখন আর পাই না। আমাদের নাগালে বাজারে এখন আর কিছুই নাই।’

সিরাজের সঙ্গে বাজারে আসা আরেক দিনমজুর মো. আয়নাল হোসেন বলেন, ‘বাজারে সিন্ডিকেট কইরা সবকিছুর দাম বাড়াইয়া দিতাছে। আমগোর ডাইল-ভাত খাইতে খরচ বাইড়া গেছে। ৪৫ টাকায় মোটা চাউল শ্যাষ কবে কিনছি মনে নাই। মোটা চাউল এখন ৫০-৫২ টাকার নিচে পাওন যায় না। মসুর ডাউলের দাম ১০০ টাকা। ভরসা ছিল অ্যাংকর ডাউল। সেইটার দাম কেজিতে ১০-১৫ টাকা বাইড়া গেছে। খরচ কুলাইতে না পাইরা খাওন কমাইয়া দিছি।’

কেবল সিরাজ ও আয়নাল নন, বাজারে কম দামি পণ্য হিসেবে পরিচিত পণ্যগুলোর দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় কষ্টে আছে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন হতদরিদ্ররা। কদমতলী এলাকায় বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে দিনশেষে পরিবারের জন্য বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরেন মোসাম্মত রাহেলা। তিনি বলেন, ‘আগে কম দামের বাজারে গিয়া ১০-২০ টাকার তেল, খারাপ মানের পেঁয়াজ, আলু, ফালাইন্না মাছ, ডিম কিইনা খাইছি। অহন এইগুলাও কিইনা খাইতে কষ্ট হইতাছে। সামান্য লবণের দামটাও বাইড়া গেছে।’

রাজধানীর বাজার চিত্র ও সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশ অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গরিবের অ্যাংকর ডালের দাম গত এক বছরে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৩ টাকা বেড়ে সর্বোচ্চ ৭৫ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। দেশি পেঁয়াজের দাম বরাবরই বেশি হওয়ায় খেটে খাওয়া মানুষ আমদানিকৃত পেঁয়াজের ওপরেই বেশি নির্ভর করে। অথচ তুলনামূলক কম দামের এ পেঁয়াজেরও দাম বেড়েছে। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে তা অতিরিক্ত বেড়েছে। বাজারচিত্র বলছে, এক বছরে এ পেঁয়াজের দাম প্রতিকেজিতে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এ সময়ে রান্নায় প্রয়োজনীয় খোলা মরিচের গুঁড়া কিংবা হলুদের গুঁড়ার দামও অতিরিক্ত বেড়েছে। কারণ শুকনামরিচের দাম এখন প্রতিকেজি ৫০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। গত বছর যা ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়ও পাওয়া গেছে। একইভাবে হলুদের দামও অনেক বাড়তি। আরেক দরকারি পণ্য কাঁচামরিচ এখন আর ১০-২০ টাকায় কিনে পোষাচ্ছে না ভোক্তাদের। কারণ প্রতিকেজি এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা।

কথায় আছে, গরিবের যখন আর কোনো উপায় না থাকে, তখন কম দামের আলুই ভরসা। কিন্তু বর্তমানে এ আলু আর সস্তা পর্যায়ে নেই। অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দেখাদেখি আলুতেও থাবা বসিয়েছে সিন্ডিকেট। চলতি বছর সন্তোষজনক উৎপাদনের পর কৃষকের হাতে আলু ফুরাতেই হিমাগারগুলো থেকে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে কৃত্রিমভাবে দাম অতিরিক্ত বাড়ানো হচ্ছে। গত বছর এই সময় ২৪ টাকায় এক কেজি আলু কেনা গেছে, যা এখন ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিছুদিন আগে এর দাম ৫০ টাকায় উঠে গিয়েছিল।

সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে গরিবের সহজলভ্য প্রোটিনের উৎস হিসেবে পরিচিত ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে। গত বছর এই সময় এক হালি ডিম ৩৬ থেকে ৩৮ টাকায় কেনা গেছে। বর্তমানে তা বেড়ে আকাশচুম্বী হয়েছে। মাত্র চারটি ডিম কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৫৫ টাকা। বছরের ব্যবধানে ব্রয়লারে কেজিতে খরচ বেড়েছে ২৫ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত।

গরিবের নাগালে নেই সস্তার পাঙ্গাশ মাছও। গত বছর ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা কেজিতে এ মাছ কেনা গেলেও বর্তমানে তা ২০০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। বেশিরভাগ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা কেজি, যা কখনো সর্বোচ্চ ২৪০ টাকায়ও বিক্রি হয়। তেলাপিয়ার কেজি এখন ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া ও কইয়ের মতো মাছের উৎপাদন অনেকটা বেড়েছে। কিন্তু বাজারে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। দাম কেন বাড়ছে, সেটাও বলতে পারছেন না বিক্রেতারা।

বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লবণের দামও বেড়ে গেছে। টিসিবির হিসাবই বলছে, এক বছরে পণ্যটির দাম সাড়ে ১৭ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। আগে ৩০ টাকায় এক কেজি আয়োডিনযুক্ত লবণের প্যাকেট কেনা গেছে। এখন তা ৩৮ টাকা হয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ব্যবসায়ীরা আগে যেখানে এক টাকা লাভে সন্তুষ্ট হতো, এখন আর হচ্ছে না। এই লোভস্ফীতি বা অতিমুনাফা মূল্যবৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে গরিবের পণ্যগুলোও বাদ পড়ছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আমাদের সবার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ কীভাবে যে জীবন ধারণ করছে, সেটা কল্পনা করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম অতিরিক্ত বাড়ানো হচ্ছে, আর তার চরম মাশুল গুনতে হচ্ছে দরিদ্রদের। তাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় তলানিতে পড়েছে বা শেষ হয়ে গেছে, ধারকর্য করছে। তারা অনেক কষ্টে আছে। সরকারের এই দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

ক্যাবের সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, বাজারে আমিষের উৎসগুলো এমনিতেই অনেক দামি। এর মধ্যে ব্রয়লার মুরগি, ডিম, পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া মাছের মতো পণ্যগুলো আগে অনেক কম দামে পাওয়া যেত। কিন্তু অন্যান্য পণ্যের দেখাদেখি এসব পণ্যের দামও অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সিন্ডিকেটের থাবা থেকে এসব পণ্যও বাদ পড়ছে না। এতে নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র মানুষ আমিষ খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে, যা স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে শিশুস্বাস্থ্যে। এতে দেশের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতাও কমে যেতে পারে।

অর্থ বাণিজ্য জাতীয় শীর্ষ সংবাদ