স্টাফ রিপোর্টার‘সিন্ডিকেট’ আছে না নেই নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীলদের বিতর্কের মধ্যেই প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। চড়া মূল্যের কারণে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ নি¤œ ও সীমিত আয়ের মানুষ। গত সপ্তাহগুলোতে সবজির দাম কাছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এ সপ্তাহে ফের বেড়েছে। সবচেয়ে কম দামে যে সবজি বিক্রি হচ্ছে সেটিও ৪০ টাকায়। খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েও সংসার চালাতে হীমশীম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাজারে গিয়ে ক্রেতারা দাম বেশি হওয়ায় এক কেজির যায়গায় আধা কেজি, আধা কেজির যায়গায় এক পোয়া পণ্য কিনছেন। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকার একাধিক পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মোটা চাল বেশির ভাগ দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। পাইজাম ও বিআর-২৮ চাল এখন মানভেদে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। যা গত সপ্তাহে ৫২ থেকে ৫৮ টাকার মধ্যে ছিল। ক্রেতারা জানান, তিন দিন আগে বিআর-২৮ চাল কিনেছেন প্রতি কেজি ৫২ টাকা দরে। এখন ৫৫ টাকা। স্বর্ণা চালের সরবরাহ না থাকায় প্রভাব পড়েছে অন্যান্য মোটা চালের দামে। বেড়েছে পাইজামের দামও। সরু চালের দাম বাড়েনি। এখন মিনিকেট ৬৮ থেকে ৭০ টাকা ও নাজিরশাইল চাল ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। যা গত সপ্তাহেও একই ছিল।
অন্যদিকে, চলতি সপ্তাহে খুচরা পর্যায়ে সব ধরনের মসুর ডালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। গত সপ্তাহেও প্রতি কেজি মোটা মসুর ডাল ৯০ থেকে ৯৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। সেই ডালের কেজি এখন ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা। মাঝারি দানার মসুর ডালের কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় উঠেছে। আর ভালো মানের, অর্থাৎ সরু দানার মসুর ডালের কেজি পড়ছে এখন ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকা। গত সপ্তাহে এই ডালের খুচরা দাম ছিল ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা কেজি।
মাছের বাজারে দেখা যায়, গরিবের মাছ পাঙাশ (বড় সাইজের) বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। ছোট আকারের পাঙাশ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। এ ছাড়া ইলিশ মাছ কেজিপ্রতি ১০০০ টাকা, রুই মাছ ৪০০ টাকা, কই মাছ ২৫০ টাকা, ট্যাংরা মাছ ৭০০ টাকা, শিং মাছ ৪৫০ টাকা, তেলাপিয়া ২৪০ টাকা, চিংড়ি মাছ ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে আগের মতোই আছে গোশতের দাম। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৮০ টাকায়, লেয়ার মুরগি ৩৮০ টাকায়, সোনালি মুরগি ৩৫০ টাকা আর দেশি মুরগি প্রতি কেজি ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অপরদিকে গরুর গোশত প্রতি কেজি ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকায় আর খাসির গোশত প্রতি কেজি ৯৮০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
যাত্রাবাড়ি মোড় বাজারে আলু ও পেঁয়াজ বিক্রেতা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ভারতীয় পেঁয়াজ আমার কেনাই আছে ৬২ টাকা। আনতে খরচ হয়, আবার নষ্ট বের হয়। তাই আমাকে ৭০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার শুনছি, ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানিতে খরচ বেড়েছে।
দাম বেড়েছে সবজির। এসব বাজারে বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার ওপরে। লম্বা বেগুন ১১০, গোল বেগুন ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া করলা ১০০, গাজর ১৫০-১৮০, টমেটো ১২০, বরবটি ১০০, কচুরমুখি ১০০, কাঁচা মরিচ ২০০, ধনেপাতা ২০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। কেজি প্রতি ৬০ টাকার ওপরে বিক্রি হওয়া সবজিগুলোর মধ্যে রয়েছে শসা ৬০-৭০, পটল ৬০-৮০, কাঁকরোল ৮০, মূলা ৬০, ধুন্দল ৮০, ঢেঁড়স ৮০, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা। লাউ ৮০, চাল কুমড়া ৭০-৮০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে কম দামে যে পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে সেটি পেঁপে- ৪০ টাকা। মিষ্টি কুমড়াও বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়।
যাত্রাবাড়িতে সাপ্তাহিক বাজার করতে আসা হাফিজুর ইসলাম নামের এক ক্রেতা বলেন, আগে বেগুন কিনতাম ১৫-২০ টাকা কেজিতে, আজ কিনতে হচ্ছে ১০০ টাকায়! কবে আবার আগের দামে কিনতে পারবো? সবকিছুর খরচ বেড়েছে, তাই উৎপাদন খরচও বেড়েছে তা জানি। কিন্তু ১০০ টাকা কেজি হওয়ার কথা না। আমরা সীমিত আয়ের মানুষ। এক মাস আগেও এক কেজির যায়গায় আধা কেজি কিনতাম। এখন এক পোয়া (২৫০ গ্রাম) কিনতে বাধ্য হচ্ছি। এভাবে জীবন আর চলে না। শরিয়ত উল্লাহ নামের এক বেসরকারি চাকুরে বলেন, প্রধানমন্ত্রী আর বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেট নিয়ে বিতর্ক করেন; অথচ আমরা চলতে পারছি না। এতো উন্নয়ন কিন্তু আমরা ঠিকমতো খেতে পারছি না। এ উন্নয়ন দিয়ে কার জন্য?
এছাড়া আজ মুদি দোকানের পণ্যের দাম রয়েছে আগের মতোই। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকা, চিনি ১৩৫ টাকা, মুসর ডাল ১২৫ টাকা, মুগ ডাল ১২০ টাকা, খেসারি ডাল ৭০ টাকা, বুটের ডাল ৮৫ টাকা, ছোলা ৭৫ টাকা, দুই কেজি প্যাকেট ময়দা ১৪০ টাকা, আটা দুই কেজির প্যাকেট ১২০ টাকা, খোলা সরিষার তেল প্রতি লিটার ২২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মাছ কিনতে আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সব কিছুর দাম এমনিতেই বেশি। কিন্তু আমি ভাবতেও পারছি না চিংড়ি মাছের কেজি দুই হাজার টাকা। আমার ছেলেমেয়ে চিংড়ি মাছ খেতে পছন্দ করে, কিন্তু এ রকম দাম হলে কীভাবে খাওয়াবো?’
দেশে প্রতিটি পণের দাম যে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে এ জন্য অসৎ ব্যবসায়ী সি-িকেটতে দায়ী করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা সি-িকেট করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। এরা এতো শক্তিশালী যে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অসুবিধায় পড়তে হবে।’ শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বলেছিলেন, ‘মানুষ বাজারে গিয়ে পণ্যমূল দেখে চোখের পানি ফেলছে। মানুষের এই কান্না সহ্য হয় না।’ এ প্রসঙ্গে কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী এমন বক্তব্য দিয়েছেন কিনা জানেন না। তিনি বাণিজ্যমন্ত্রীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করবেন বলে জানান। কিন্তু পরের দিন বাণিজ্যমন্ত্রী জানান তাকে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। সরকারের ওপর মহলে বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে এই চাপান উদোন চলছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ সংসার চালাতে বিপন্নবোধ করছে।