নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশে প্রথমবারের মতো দ্রুতগতির উড়ালসড়কের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যার মাধ্যমে সাড়ে ১১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া যাবে মাত্র ১০ মিনিটেই। এর মধ্য দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপেসওয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ বিমানবন্দর-বনানী-তেজগাঁও সাধারণের যান চলাচল শুরু হচ্ছে আজ ভোর ৬টা থেকে। নির্দিষ্ট পরিমাণ টোল দিয়ে ব্যবহার করা যাবে এই উড়ালপথ। এতে যানজট থেকে অনেকটাই স্বস্তি মিলবে রাজধানীবাসীর। প্রকল্পের পুরো অংশ কুতুবখালী পর্যন্ত চালু হবে আগামী বছরের জুনে। সেটি হলে দেশের যোগাযোগ খাতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বলে মনে করে সরকার। অবশ্য প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ খুলে দেওয়া দেশবাসীর জন্য একটি নির্বাচনী উপহার বলে মনে করেন সরকার-সংশ্লিষ্টরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বেলা সাড়ে ৩টার দিকে দ্রুতগতির প্রথম উড়ালসড়ক (ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) উদ্বোধন করেছেন। রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশে ভ্রমণও করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী উড়ালসড়কে প্রথম টোল দেন। এরপর তিনি গাড়িতে করে উড়ালসড়ক পার হন। এতে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরের সময় লেগেছে ১৪ মিনিট। এরপর তিনি মোনাজাতে অংশ নেন। পরে আগারগাঁওয়ে পুরনো বাণিজ্য মেলার মাঠে সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। দ্রুতগতির এই উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে রেললাইন ধরে তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে এই উড়ালসড়ক। বাধাহীন দ্রুতগতির এই উড়ালসড়কের মাধ্যমে খুব সহজেই চট্টগ্রামমুখী গাড়িগুলো ঢাকাকে পাড়ি দিতে পারবে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে প্রথম যাত্রী হিসেবে নিজের হাতে টোল দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -পিআইডি
র্যাম্প ও টোলপ্লাজা : পুরো উড়ালসড়কে ৩১টি স্থান দিয়ে যানবাহন ওঠানামা (র্যাম্প) করার ব্যবস্থা থাকছে। র্যাম্পসহ উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য হবে ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। উড়ালসড়কে ১১টি টোলপ্লাজা থাকছে। পুরো পথ চালু হলে তা যানবাহনে পাড়ি দিতে ২০ মিনিট লাগবে বলে প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কাওলা থেকে তেজগাঁও অংশ পাড়ি দিতে লাগবে ১০-১২ মিনিট।
গতকাল প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর পরিদর্শনের সুবিধার্থে তুলনামূলক স্বাভাবিক গতিতেই চলেছে। আশা করা হচ্ছে, সাধারণ পরিবহনও একই সময়ে এ সড়ক অতিক্রম করতে পারবে। কারণ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গতি রোধ করার মতো কোনো উপকরণ বা কারণ নেই। সিগন্যালবিহীন একমুখী পথে শোঁ শোঁ করে চলবে গাড়ি। এতে পণ্য পরিবহনের সময় কমবে। সাশ্রয় হবে পরিবহন ব্যয়। এতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পণ্য পরিবহনে যোগ হলো নতুন এক অনন্য সুবিধা।
প্রকল্প ব্যয় : সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এ প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি এবং প্রকল্পের সমাপ্তির মেয়াদ জুন ২০২৪ সাল নাগাদ। ফলে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে লাগছে ১৩ বছর। কিন্তু প্রকল্প শুরুর প্রথম সাত বছরে কাজ এগোয়নি ১০ শতাংশও। তবে থাইল্যান্ডভিত্তিক ইটাল-থাই ও চীনের সিনোহাইড্রোম এবং সিএসআই শেয়ার ভাগাভাগি করে এটি বাস্তবায়ন করায় মূলত বাস্তবে রূপ নিল এই প্রকল্প। ১৩ বছরে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। প্রকৃত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণ মূলত নকশা পরিবর্তন ও সময়ক্ষেপণ। প্রথম নকশায় হাতিরঝিলের ওপর দিয়েই এর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। প্রাক্কলিত ব্যয়ের ২৭ শতাংশ বহন করছে বাংলাদেশ সরকার। এর পরিমাণ ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ বিনিয়োগকারী আর্থিক সংস্থা চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ৪৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার (আইসিবিসি) সঙ্গে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ মোট ৮৬১ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি সই করা হয়। এর মধ্যে মোট ৩৮২ দশমিক ৭১ মিলিয়ন ডলার ছাড় করা হয়েছে।
যেভাবে ওঠানামা করা যাবে : এ উড়ালসড়কে উঠতে ও নামতে কিছু নিয়মকানুন মানতে হবে। দুই ও তিন চাকার কোনো যানবাহন নিয়ে এ উড়ালসড়কে ওঠা যাবে না। যারা ফার্মগেট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিনরোড অথবা শাহবাগ, সেগুনবাগিচা ও পুরান ঢাকা থেকে এসে উড়ালসড়কে উঠতে চান, তাদের যেতে হবে বিজয় সরণি ওভারপাস অথবা তেজগাঁও এলাকায়। বিজয় সরণি হয়ে র্যাংগস ভবন ভেঙে যে ওভারপাসটি তৈরি করা হয়েছে, সেটিতে উঠে তেজগাঁওয়ে যাওয়ার আগেই উড়ালসড়কের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে। তেজগাঁও থেকে বিজয় সরণির দিকে আসতে ওভারপাসে আরেকটি সংযোগ রয়েছে ওঠার জন্য। রাজধানীর দক্ষিণ, পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বাংশের মানুষের জন্য উড়ালসড়কে ওঠার এই পথটিই সহজ। তবে যারা বনানী যেতে পারবেন, তারা বনানী রেলস্টেশনের সামনে দিয়ে উড়ালসড়কে উঠতে পারবেন। উত্তর দিক থেকে এসে নামার জন্য সহজ পথ ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, নিউমার্কেটগামী যানবাহনের ইন্দিরা রোডে নামাই সুবিধাজনক। এ ছাড়া হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে ওঠা যাবে, নামাও যাবে। প্রগতি সরণি ও বিমানবন্দর সড়কের আর্মি গলফ ক্লাব থেকেও ওঠা যাবে। বনানী কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর নামার একটি লুপ রয়েছে। এ ছাড়া মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে, ফার্মগেট প্রান্তে ইন্দিরা রোডের পাশে নামা যাবে। উত্তর অভিমুখী যানবাহনের ওঠার স্থান হলো- বিজয় সরণি ওভারপাসের উত্তর ও দক্ষিণ লেন; বনানী রেলস্টেশনের সামনে। উত্তর অভিমুখী যানবাহন নামার স্থান হলো-মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে। বনানী কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর সামনে বিমানবন্দর সড়ক; কুড়িল বিশ্বরোড ও বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনালের সামনে।
দুই ও তিন চাকার যান চলাচল নিষেধ : এদিকে গতকাল সেতু বিভাগের এক গণবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ঢাকা উড়ালসড়কে দুই ও তিন চাকার যানবাহন চলাচল করতে পারবে না। তাই মোটরসাইকেল বা অটোরিকশা নিয়ে উড়ালসড়কে ওঠার চিন্তা করবেন না। গাড়ি নিয়ে গিয়ে উড়ালসড়কে দাঁড়ানো ও যানবাহন থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পথচারীরা উড়ালসড়কে উঠতে ও চলাচল করতে পারবেন না। সেতু বিভাগ বলছে, মূল উড়ালসড়কে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলাচল করতে পারবে। আর ওঠানামার স্থানে (র্যাম্প) সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার।
টোলের হার : শ্রেণি-১ : কার, ট্যাক্সি, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) এবং হালকা ট্রাক (৩ টনের কম) হলে টোল ৮০ টাকা। শ্রেণি-২ : মাঝারি ট্রাক (৬ চাকা পর্যন্ত) টোল ৩২০ টাকা। শ্রেণি-৩ : ট্রাক (৬ চাকার বেশি) টোল ৪০০ টাকা। শ্রেণি-৪ : সব ধরনের বাস (১৬ সিট বা তার বেশি) টোল ১৬০ টাকা।
উৎসুক জনতার ভিড় ঠেকাতে হিমশিম পুলিশ : এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধনী জনসভায় (সুধী সমাবেশ) যোগ দিতে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে বাসে, রিকশায় ও পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছান। এতে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। তবু ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রকল্প এলাকার চারপাশে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সেই নিরাপত্তার চাদর ভেদ করে সাধারণ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর এক নজর দেখতে রাস্তার দুই ধারে, বাড়ির ছাদে অবস্থান নেন। অনেকেই প্রধানমন্ত্রীকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। এ সময় উৎসুক জনতার ভিড় ঠেকাতে হিমশিম খেতে হয় নিরাপত্তা বাহিনীকে।
বাকি অংশের জন্য অপেক্ষা : ঢাকা উড়ালসড়কের (ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে রেললাইন ধরে তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে এই উড়ালসড়ক। উড়ালপথের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ খুলে দেওয়া হলেও তৃতীয় অংশ তেজগাঁও থেকে কুতুবখালীর জন্য অপক্ষো করতে হবে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। ২০০৯ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটির নির্মাণ চুক্তি হয় ২০১১ সালে। নির্মাণকাল ধরা ছিল সাড়ে তিন বছর। অর্থায়ন, নকশা ও রুটসহ নানা জটিলতার কারণে এর অর্ধেক অংশ বাস্তবায়নেই কেটে গেছে প্রায় ১৩ বছর। অন্যদিকে দ্বিতীয় উড়ালপথ ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজও চলমান।