নির্বাচন কমিশন (ইসি) আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু করলেও ভোট নিয়ে আপাতত ভাবছে না বিএনপি। দলটির সব মনোযোগ এখন আন্দোলনে। যদিও আন্দোলনের পাশাপাশি ভেতরে ভেতরে নির্বাচনী প্রস্তুতিও রয়েছে বিএনপির। দলটির সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আন্দোলনে সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে তারা। আর সরকার যদি এই দাবি উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়, বিএনপি তা প্রতিহত করবে এবং সেই নির্বাচনে অংশ নেবে না। তবে তপশিল ঘোষণা পর্যন্ত চলমান আন্দোলনকে টেনে নিয়ে যেতে চায় না দলটি। এর আগেই রাজপথে একদফা আন্দোলনের ফয়সালা করতে চান নীতিনির্ধারকরা।
বিএনপির দাবি, একদফার যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত কোনো দলই শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে ভোটে যাবে না। আর যেসব দল যুগপতে নেই, কিন্তু অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন চায় তারাও ওই নির্বাচন বর্জন করবে। দলটির নীতিনির্ধারকদের দাবি, বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের পক্ষে কোনোভাবেই একতরফা নির্বাচন করা সম্ভব নয়। ফলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সরকারকে কোনো না কোনো বিকল্প পথ বেছে নিতেই হবে। বিএনপি এ-ও মনে করছে, নির্বাচন বা আন্দোলনের মাঠে এবার বিএনপিই সরকারের একমাত্র প্রতিপক্ষ নয়। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হোক, এটি যেমন দেশের সাধারণ মানুষ চায়। তেমনি গণতান্ত্রিক বিশ্বেরও চাওয়া এটি। এই ইস্যুতে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে তারা। শিগগির এই চাপ আরও জোরালো হবে। বিশেষ করে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থান নিয়েছে, সেটিতে আস্থার জায়গা পাচ্ছে বিএনপি। এ ইস্যুতে ভিসা নীতি ঘোষণাসহ মার্কিন তৎপরতা আশা জোগাচ্ছে তাদের।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, তপশিল ঘোষণা দিল, আর নির্বাচন হয়ে গেল—ব্যাপারটা এত সহজ নয়। ‘একতরফা’ নির্বাচন এবার এত সহজ হবে না। মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তারা এ দেশে আর কোনো প্রহসনের নির্বাচন হতে দেবে না। তাই এবার জনগণ আর পিছপা হবে না। মুক্তিযুদ্ধের পরে এবার সবচেয়ে বড় যুদ্ধে তারা নেমেছে। এবার মানুষ জয়ী হবে। তিনি আরও বলেন, এই অনির্বাচিত সরকার ভয়ে জনগণের কাছে যেতে পারছে না। বিএনপির এক ভয়, নির্বাচনের আরেক ভয়। দুই ভয়ের মধ্যে তারা আছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান গতকাল জানিয়েছেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। তবে তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছে। ভোট হবে ব্যালটে।’ উল্লেখ্য, সংবিধানে জাতীয় সংসদের মেয়াদপূর্তির আগের ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা আছে। আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি চলতি একাদশ জাতীয় সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হবে। তার আগের ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে হবে। সে হিসাবে, ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে এই নির্বাচন করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির এবার আন্দোলনে জেতাটাই একমাত্র লক্ষ্য। কারণ, এবার বিএনপিকে ছাড়া সরকার যদি নির্বাচন করতে পারে, তাহলে দলটি অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে। এ বিষয়টি বিএনপির নেতৃত্বও বিবেচনায় নিচ্ছে বলে নেতাদের অনেকে বলছেন। তাই আগামী দিনে আন্দোলন সফল করাই বিএনপির বড় চ্যালেঞ্জ।
বিগত দুটি নির্বাচন শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে প্রতিহতের ডাক দিয়েছিল। কিন্তু সেই নির্বাচন ঠেকানো সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ তখন বিজয়ী হয় এবং টানা দ্বিতীয় বারের মতো সরকার গঠন করে। ওই সময় নির্বাচন নিয়ে মধ্যস্থতা করতে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসেছিলেন। তার উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বৈঠকও হয়। বিএনপি নেতাদের দাবি, তখন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচনের পর দ্রুততম সময়ে আরেকটি নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছিল সরকার। কিন্তু পরে তারা কথা রাখেনি। এরপর দলীয় অবস্থান পরিবর্তন করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশায় প্রধানমন্ত্রীর ডাকা সংলাপেও গিয়েছিলেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করে দলটি। মাত্র সাতটি আসনে বিজয়ী হয়। নির্বাচনের পর বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংলাপে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেননি প্রধানমন্ত্রী।
সেই অভিজ্ঞতা থেকে এবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় বিএনপি। একদফা দাবিতে গত ১২ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করেছে তারা, যেখানে প্রায় অর্ধশত দল সম্পৃক্ত। জানা গেছে, মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে একদফার আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি নিয়ে ফের মাঠে নামার চিন্তা রয়েছে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের। আর সেপ্টেম্বরের শেষদিকে গিয়ে আন্দোলন গতি লাভ করবে। ওই সময় ঢাকায় ফের মহাসমাবেশ, গণসমাবেশ বা বড় ধরনের কর্মসূচির চিন্তা রয়েছে হাইকমান্ডের। এর মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের ‘শেষ ধাপ’ শুরু হবে। লক্ষ্য অর্জন পর্যন্ত সেই আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা। জানা গেছে, সেই পর্যায়ে কর্মসূচি হবে সম্পূর্ণ ঢাকাকেন্দ্রিক। বিচারালয়ের সামনে অবস্থান ছাড়াও নির্বাচন কমিশন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়ের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের কর্মসূচি আসবে। এর সঙ্গে টানা অবস্থান কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তাও রয়েছে বিএনপির হাইকমান্ডের।