সরকার পতনে বিএনপিতে অভিন্ন চ্যালেঞ্জ। আন্দোলন, কূটনৈতিক মিশন— এক সাথেই চলছে। জ্বালাও-পোড়াও, সংঘাত-সহিংসতায় না গিয়ে গণতান্ত্রিক পথগুলোকেই বেছে নিয়েছে বিএনপি। আপাতত জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই চূড়ান্ত মুভমেন্টে যাচ্ছে না দলটি। তবে ক্ষমতাসীনদের গতিবিধি ও সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যদি কোনো বিশেষ ঘোষণা দেন তাতেও প্রস্তুতি রয়েছে হাইকমান্ড ও তৃণমূলে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে নভেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন। যখনই ঘোষণা করা হবে, তখন থেকেই শর্টটাইম বিশেষ মুভমেন্ট নিয়ে মাঠে নামবে বিএনপি ও তার শরিকরা।
দলটিকে চাপে রাখতে রাজনৈতিক পুরোনো মামলাগুলোকে সরকার আবারও সামনে নিয়ে আসছে বলে অভিযোগ তুলে বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, অর্ধকোটি নেতাকর্মীর নামে মামলা রয়েছে। আট শতাধিক নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এবং ৪০০ জন গুম হয়েছেন। নাশকতা ও বিস্ফোরক আইনের মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ শীর্ষদের দ্রুত সাজা নিশ্চিতে ক্ষমতাসীনরা উঠেপড়ে লেগেছে। এমন দৃশ্যপটেও বিএনপি এবার চিন্তিত নয়। তারেক রহমান সব ধরনের বিকল্প প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। প্রথম সারির নেতাদের সরকার যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আটকও করে তাহলে তৃণমূল ও মাঠপর্যায়ের নেতাদের দিয়েই নির্দিষ্ট ছক বাস্তবায়ন করবেন। গোপনীয়তা সুরক্ষাসহ তার নেতৃত্বের ওপর নেতাকর্মীরা বিশ্বস্ত রয়েছেন। কর্মসূচি প্রণয়ন ও ঘোষণার প্রক্রিয়াকে সবাই সাধুবাদ জানাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, শর্টটাইমে ঢাকাকে টার্গেট করেই কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বৃহৎ অবস্থান, নির্বাচন কমিশন ও সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিসহ অন্তত ১০টি স্পট। এ ছাড়া দেশের সব জেলাপ্রশাসক কার্যালয়ে অবস্থানেরও চিন্তা রয়েছে। অতীতে বাকশাল প্রতিরোধ আন্দোলন, স্বৈরাচার এরশাদ পতনের অভিজ্ঞতা থেকে আন্দোলন ছক তৈরি করা হয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে, শান্তিপূর্ণভাবেই বিএনপি ও জোট নেতারা উল্লিখিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাবেন। এতে সরকার যদি বাধা দেয় বা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে না দেয় তাতেও বিএনপি লাভবান হবে। আইনশৃঙ্খলা বা আওয়ামী লীগ থেকে যদি কোনো বাধার সম্মুখীন হয় তাহলে আন্তর্জাতিকভাবে সরকারকে গণতন্ত্রবিরোধী ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হস্তক্ষেপকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে সহজ হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষরা সামনে সারিতে থাকার পর অভিমুখে যাত্রায় যদি বাধা আসে প্রথম পর্যায়ে তারা কূটনৈতিক অবস্থায় এ বিষয়গুলো তুলে ধরবেন।
ইতোমধ্যে বিএনপি কূটনৈতিক মহলগুলোতে স্পষ্ট করেছে, এখন যদি বিএনপি কঠিন কোনো কর্মসূচি দেয় তাহলে সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে মানুষের জীবনযাত্রায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। দেশের বেশির ভাগ এখন শুধু একটি ঘোষণার অপেক্ষায় আছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে পড়লে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না। কূটনৈতিক সমঝোতায় শেষ বেলায়ও যদি সরকার সরে না দাঁড়ায়, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ তৈরি না করে তাহলে বিএনপিকে ঘোষণা দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ দুই সিনিয়র নেতা ও জোটের অন্তত তিন নেতা বলেন, বিএনপি ঢাকামুখী কর্মসূচিগুলো থেকে সরকারকে গণতন্ত্রবিরোধী সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করবে। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে অবস্থান ও অভিমুখে যাত্রায় যদি বাধা আসে তাতে বিএনপিই বেশি লাভবান হবে। দলের শীর্ষ নেতাদের যদি বাধা দেয়া হয় তাৎক্ষণিক কর্মসূচি দিয়ে সরকার পতন পর্যন্ত মাঠে থাকতে সিরিজ কর্মসূচি দেয়া হবে। ইতোমধ্যে দলের চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঢাকাসহ সারা দেশে আন্দোলন সফলে রোডম্যাপ নিয়েছেন। বিভাগীয় সমাবেশ ও ঢাকায় অবস্থান, পদযাত্রা, গণমিছিল থেকে সরেজমিন অভিজ্ঞতা নিয়েছেন। শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও কূটনৈতিক মিশনেও যদি সমঝোতায় না আসে তাহলে সরকারকে সরে যাওয়ার মতো কর্মসূচি দেয়া হবে।
বিএনপির জোট সঙ্গী নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এখন আর লুতুফুতু আন্দোলনের সময় নেই। কে কী করবে কে কী করছে তা দেখার সুযোগ নেই। কোন দেশ কী বলছে তার হিসাবেরও সময় নেই। যদি আন্দোলন করার মতো না করতে পারি তাহলে কোনো লাভ হবে না। এই সরকার সরাতে আন্দোলনের বিকল্প নেই।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘দেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। যেদিন তফসিল ঘোষণা করা হবে সেদিনই হবে এই সরকারের বিদায়যাত্রা। নিশিরাতের সরকারকে রাস্তায় নামাতে দেশের মানুষ অপেক্ষা করছে। আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবে এবং নির্দলীয় সরকারের হাতেই আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এ দেশে অবৈধ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেই নির্বাচন আর বাস্তবায়ন করতে পারবে না সরকার। মানুষ এবার ভোটাধিকারের সংগ্রাম বাস্তবায়ন করবে। লাখো মানুষ আন্দোলনে নামবে, দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই এই আন্দোলন হবে। এই সরকারকে দেশের জনগণ যেমন চায় না, কূটনীতিকরাও চান না। এই সরকার জনগণ ও বিশ্ব থেকে গণবিচ্ছিন্ন।’