১৫ আগস্ট সেনা কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার কাহিনি নঈম নিজাম

১৫ আগস্ট সেনা কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার কাহিনি নঈম নিজাম

বারবার বসলেও সেনা আইন লঙ্ঘন, বিদ্রোহে অংশগ্রহণ, দেশের রাষ্ট্রপতিকে পরিবারসহ হত্যার দায়ে খুনিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, উপপ্রধান জিয়াউর রহমান, সিজিএস খালেদ মোশাররফ, ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল, পরিচালক মিলিটারি অপারেশন কর্নেল নুরুদ্দিন, আর্মি ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক সালাহ উদ্দিন, ডিজিএফআইয়ের রউফসহ দায়িত্ববান সিনিয়ররা। সবার চেহারা বদলে গেল সকালে নিষ্ঠুরতার খবর শুনে। খুনিদের বিরুদ্ধে সেদিন কেউ অবস্থান নেননি। বরং উপপ্রধান জিয়াউর রহমানসহ সবাই ব্যস্ত সবকিছু ধামাচাপা দিতে। ১৯ আগস্ট শাফায়াত জামিল যখন সেনা হেডকোয়ার্টার্সে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, তখন ব্যর্থ সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ বললেন, তুমি এতদিনে বুঝলে? সামরিক শাসন জারি হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট। তার আগে দেশে সেনাশাসন ছিল না। নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি দায়িত্ব নেওয়ার কথা। অথচ পরিকল্পনা অনুযায়ী খুনিরা নিয়ে এলো মোশতাককে। খুনিরা আগে থেকেই তাদের দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছিল। রশীদের দায়িত্ব ছিল ঘটনার পর সবকিছু সামাল দেওয়া। সবাইকে ম্যানেজ করা। ফারুক ব্যস্ত ছিল রক্ষীবাহিনীর বিদ্রোহের দিকে খেয়াল রাখতে। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি থেকে ডালিম সরাসরি আসে রেডিও স্টেশনে। পরিকল্পনা অনুযায়ী খুনিরা মোশতাককে রেডিও স্টেশন ও বঙ্গভবনে নিয়ে যায়।

সেনাবিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। একজন সাধারণ মানুষও বোঝে ফারুক-রশীদের পেছনে বড়রা না থাকলে ১৫ আগস্টের ভয়াবহতার সাহস পেত না। খুনিরা বারবার বলেছে, তারা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে আটক করতে। তারপর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যেতে। পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রকাশ্যে বিচার করতে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে খুনিদের প্রথম দল প্রবেশের পর বঙ্গবন্ধু ধমক দিতেই তারা থমকে দাঁড়ায়। গুলি চালায় দ্বিতীয় দল। সবকিছু ঘটেছে নিখুঁত সেনা পরিকল্পনায়। প্রথম দল বঙ্গবন্ধুকে ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার কথা বলেছিল। কার সাহসে তারা দেশের রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতাকে এমন কথা বলল? আড়াল থেকে সেই সাহস কে দিয়েছিল? এতদিন পর অনেক প্রশ্ন উঠে আসে। বঙ্গবন্ধুর মূল শক্তি ছিল সাধারণ মানুষ। সেই জনগণের সামনে কি বঙ্গবন্ধুকে তারা নিতে পারত? বালকও বোঝে এটা একটা ফালতু কথা। বঙ্গবন্ধুকে জীবিত রেখে কারও কিছু করার মতো অবস্থান ছিল না বাংলাদেশে। তাঁর সাহস, শক্তি, ব্যক্তিত্ব, জনসম্পৃক্ততা বিশ্বজুড়ে বিরল। খুনিদের মূল পরিকল্পনা জানত শুধু ফারুক, রশীদ ও আড়ালের গডফাদাররা। খুনিদের প্রথম গ্রুপকে বলা হয় বঙ্গবন্ধুকে আটক করতে। দ্বিতীয় গ্রুপের দায়িত্ব ছিল সব শেষ করার। মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রথম গ্রুপ পরিস্থিতি অনুধাবন করতে ভিতরে প্রবেশ করে। বজলুল হুদা ও নূর প্রবেশ করে এরপর। সব শেষে রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন শেখ মণিকে হত্যা করে আসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। হুদা, নূর, মুসলেহ উদ্দিন খুনের পরোয়ানা নিয়ে অস্ত্রহাতে নিষ্ঠুর খুনি হিসেবেই প্রবেশ করেছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে।

খুনিরা জানত তাদের সামলে নেওয়ার লোক আছে। আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার মোল্লা বলেছেন, লিখেছেন, সকালে তাদের ৪৬ ব্রিগেডে নিয়ে শান্ত থাকার নির্দেশ দেন খালেদ মোশাররফ। তার সঙ্গে ছিলেন শাফায়াত জামিল। এরপর রেডিও স্টেশনে গিয়ে আনুগত্য প্রকাশের নির্দেশও আসে খালেদ মোশাররফের কাছ থেকে। পিলখানা বিডিআর সদর দফতরে রক্ষীবাহিনীর অস্ত্র আটকে দেন জেনারেল খলিল। সন্ধ্যায় জিয়াউর রহমান বঙ্গভবনে তাদের দেখে তোফায়েল আহমেদ কেন তাদের অফিসে, এ নিয়ে অসন্তোষ ব্যক্ত করেন। তিনি তাদের হুমকিও দেন। তোফায়েলকে এসবির এসপি আবদুস সালামের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। জিয়াউর রহমানকে সকালে ডালিমের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বলতে দেখেন লে. কর্নেল হামিদ। তিনি তার বইতে এ নিয়ে লিখেছেন। লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, ‘৪৬ ব্রিগেড যে কোনোভাবে ম্যানেজ ছিল।’ আরও অনেক সেনা কর্মকর্তা একই কথা বলেছেন। লিখেছেন। রাঘববোয়ালরা ম্যানেজ না থাকলে, সব না জানলে অথবা সব সামলানোর আশ্বাস না দিলে ঢাকা শহরে এত বড় ঘটনা ঘটানোর সাহস খুনিদের ছিল না। ৪৬ ব্রিগেডের ভিতর দিয়েই খুনিরা অস্ত্র নিয়ে আসা-যাওয়া করল, কেউ বাধা দিল না। রশীদ ১৫ আগস্ট যখন ৪৬ ব্রিগেডে গিয়ে বলল, আমরা মুজিবকে হত্যা করেছি, সেনা আইন অনুযায়ী শাফায়াত জামিল তখন কেন তাকে আটক করলেন না? কেন খালেদ মোশাররফ সিজিএস হিসেবে খুনিদের মুখোমুখি করলেন না রাষ্ট্রপতিকে হত্যা ও সেনা বিশৃঙ্খলার জন্য সামরিক বিচারের কাঠগড়ায়। কেন নুরুদ্দিন চুপচাপ থাকার ভূমিকা নিলেন? জাতির মনে দীর্ঘদিন অনেক প্রশ্ন জমে আছে। অনেক কিছুর উত্তর নেই। ৪৬ ব্রিগেড নিয়ে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান হলো। ৪ হাজার সৈনিক ছিল শাফায়াতের অধীনে। প্রশ্ন আসে এত সেনা থাকার পরও ১৫ আগস্ট কেন প্রতিরোধ হলো না? ৩ নভেম্বর কি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদের কোনো অভ্যুত্থান ছিল? অনেক সেনাবিশেষজ্ঞ বলছেন, ১৫ আগস্টের কুখ্যাত মেজর, ক্যাপ্টেনদের বাড়াবাড়ি অন্যদের সহ্য হচ্ছিল না। তাই ৩ নভেম্বরের অভিযানেও আরেক দল মেজর, ক্যাপ্টেনের ভূমিকা ছিল মুখ্য। একজন সিনিয়র দরকার হয় অভ্যুত্থানে, তাই তারা খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান হিসেবে বেছে নেয়। জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে দেয়। তারপর রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে পরিকল্পনা ছিল না বলেই মোশতাককে তারা রেখে দিয়েছিল। ৬ নভেম্বর সায়েমকে যখন বঙ্গভবনে নিয়ে এলো তার আগে কর্নেল তাহের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলেন। তাহেরের অবস্থান ছিল জিয়াউর রহমানের পক্ষে।
সেদিনের ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি একটি টিভিতে মুখ খুলেছেন মেজর হাফিজ। তিনি বলেছেন, তিনি ৪৬ ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর ছিলেন। মেজর রশীদ ছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের ২ বেঙ্গলের সঙ্গে। ১৫ আগস্ট মেজর রশীদ তাকে জানান, তারা রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছেন। হাফিজ সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু জানান শাফায়াত জামিলকে। তারা দুজন সেনাপ্রধানের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পথে উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জিয়াউর রহমান ভোরে শেভ করছিলেন। জিয়াউর রহমান তাদের বলেন, প্রেসিডেন্ট নেই। সো হোয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট আছে। সংবিধানে সব চলবে। মেজর হাফিজ আরও বলেছেন, সেদিন খালেদ মোশাররফ তাকে বঙ্গভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেন। তিনি বঙ্গভবন যাওয়ার পথে ৩২ নম্বরে যান। সিঁড়ির ওপর পড়ে ছিল বঙ্গবন্ধুর লাশ। তাঁকে হুদা দোতলায় নিয়ে যান। তিনি বীভৎস চিত্র দেখেন ধানমন্ডিতে।

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা ’৭৪ সালে শুরু। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কর্নেল জিয়াউদ্দিন সরকার উৎখাতের আহ্বান জানিয়ে এনায়েতুল্লাহ খানের হলিডেতে বিশাল লেখা লিখলেন। সেই লেখা লিফলেটের মতো করে প্রচার করা হলো দেশের সব ক্যান্টনমেন্টে। সেনা আইন অনুযায়ী তাকে চাকরিচ্যুত করার আগে বঙ্গবন্ধুর সামনে নিয়ে যান শফিউল্লাহ। বঙ্গবন্ধু বললেন, দেশটার মাত্র যাত্রা শুরু হলো। সবাই মিলে দেশটাকে এগিয়ে নাও। সেনা বিশৃঙ্খলার চেষ্টা কেন করছ? সমস্যা কোথায়? বঙ্গবন্ধু লেখা প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ করতে বললেন কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে। ঔদ্ধত্য নিয়ে কর্নেল জিয়াউদ্দিন বললেন, মুখ থেকে থুথু একবার ফেললে আর ফেরত নেওয়া যায় না। পরে জিয়াউদ্দিন যোগ দেন সিরাজ সিকদারের সঙ্গে। সরকার উৎখাতে সশস্ত্র পরিকল্পনা নেন। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর ভিতরে সরকারবিরোধী তৎপরতা চালাতেন। তিনি ছিলেন জাসদের গণবাহিনীর সেনা ইউনিট প্রধান। একটা দেশের সেনাবাহিনীর ভিতরে এভাবে রাজনৈতিক ধারা তৈরি করে বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা ছিল নজিরবিহীন। তাহেরের চাকরি যাওয়ার পর তাকে পানি উন্নয়ন বোর্ডে পুনর্বাসন করা হলো। তিনি সেখানে বসেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের উৎখাতের তৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন।

১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর শীর্ষপদ আঁকড়ে থাকা মানুষগুলো আগে কিছু না জানলেও সকালে সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠেন সব স্বাভাবিক করতে। আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যার সাক্ষ্য দেওয়ার সময় জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ অনেক কথাই বলেছেন। তিনি আদালতকে বলেন, ‘আমি যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলি তিনি আমার গলার আওয়াজ শুনে বলে উঠলেন, শফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও। প্রতি উত্তরে আমি বলেছিলাম, আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেটআউট অব দ্য হাউস? আমি জিয়া ও খালেদ মোশাররফকে ফোন করি। তাদেরকে তাড়াতাড়ি আমার বাসায় আসতে বলি। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে তারা আমার বাড়িতে এসে পড়ে। জিয়া ইউনিফরমড ও শেভড ছিলেন। খালেদ মোশাররফ নাইট ড্রেসে নিজের গাড়িতে আসেন।’ মৃত্যুর আগে বঙ্গবন্ধু দেখে গেলেন তাঁর তৈরি করা সেনাবাহিনী তাঁকে হত্যা করতে এসেছে। রক্ষা করতে আসেনি কেউ।

সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফ রাতেই খবর পেয়েছিলেন। তার সোর্স তাকে রাত ৩টায় জানায়, ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেপরোয়াভাবে ট্যাংক বের হচ্ছে। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক। তারা রাষ্ট্রপতিকে খুন করতে পারে। ধরেই নিলাম, ১০ দিন আগে তিনি খবর পাননি। কিন্তু মধ্যরাতে তো পেয়েছিলেন। তার পরও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে। খবর পাওয়ার পর সকাল ৬টা পর্যন্ত কী করলেন তিনি তার ব্যাখ্যাও ঠিকভাবে দেননি কখনো। রউফকে বদলি করে তার স্থলে কর্নেল জামিলকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তাপ্রধান জামিল নিয়োগ পেলেও তখনো নতুন কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার সময় পাননি। জামিলের গোয়েন্দা বিভাগে বদলি ভালোভাবে নেননি রউফ। লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, ১৫ আগস্ট ভোরে রউফ লুঙ্গি পরে সেনাপ্রধানের বাড়িতে যান। দিশাহীন সেনাপ্রধান তখন জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফকে ডেকে আনেন কিছু করতে। তাদেরকে সেনাপ্রধান বারবার বলছিলেন, একটা কিছু করো। সব শেষ হয়ে গেছে এমন ব্যাখ্যা দিয়ে তারা কেউ কিছু করলেন না। জেনারেল শফিউল্লাহর বিভিন্ন লেখনী, সাক্ষাৎকারে নিজের ব্যর্থতার পাশাপাশি শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সহায়তা না পাওয়ার কথাই বারবার বলেছেন। কোনো সেনা কর্মকর্তা ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় শফিউল্লাহকে সহায়তার মনোভাব দেখিয়েছেন এমন উদাহরণ একটিও নেই।

মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের লে. কর্নেল সালাহ উদ্দিন ৪টা ৩০ মিনিটে খবর পেয়ে ছুটে যান সেনাপ্রধানের বাড়িতে। সেনাপ্রধান সব শুনে ফোনে ধরার চেষ্টা করেন বঙ্গবন্ধুকে। একই সময়ে বঙ্গবন্ধু ফোন করার চেষ্টা করেন শফিউল্লাহকে। এ কারণে কেউ কাউকে পাচ্ছিলেন না কয়েক মিনিট। পরে বঙ্গবন্ধু তাকে পান। জাতির পিতার সঙ্গে কথা বলেন শফিউল্লাহ। সে সময় মিলিটারি অপারেশন পরিচালক ছিলেন কর্নেল নুরুদ্দিন। তিনি কী করলেন? তার দায়িত্ব কী ছিল? তার সঙ্গেও সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ কথা বলেছেন। ১৫ আগস্ট সেনা সদরে তিনি বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নিয়েছেন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, উপপ্রধান জিয়াউর রহমান, সিজিএস খালেদ মোশাররফসহ অন্যদের সঙ্গে। সেসব বৈঠকের কোনো ফলাফল ছিল না। এ নিয়ে প্রকাশিত বইগুলোয় দেখা যায়, ৭ নভেম্বর অফিসার হত্যা দিবসে মুক্ত জিয়ার পাশে বসা ছিলেন কর্নেল নুরুদ্দিন। তিনি জিয়াউর রহমানের পাশে বসে পরবর্তী করণীয় ঠিক করছিলেন। এই নুরুদ্দিনকে আওয়ামী লীগ ’৯৬ সালে ক্ষমতায় থাকার সময় জ্বালানি মন্ত্রী করেছিল। কেন করেছিল জানি না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমাকে বলেছিলেন, নুরুদ্দিন তার সঙ্গে বিট্রে করেছেন। নুরুদ্দিনের কৃতজ্ঞতাবোধ নেই।

লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ আর শাফায়াত জামিলের রহস্যজনক ভূমিকা সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে বিভ্রান্ত করছিল। রক্ষীবাহিনীর দুই উপপরিচালককে ৪৬ ব্রিগেডে ডেকে শান্ত থাকার নির্দেশের কথাও কর্নেল হামিদ লিখেছেন। আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার মোল্লাকে ৪৬ ব্রিগেডে ডেকে নিয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ। সেখানে ছিলেন ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল। লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, তিনি যখন প্রবেশ করলেন, তিনি দেখলেন শাফায়াত জামিলের ব্রিগেডের সবাই উল্লসিত। আর সরোয়ার মোল্লা বলেছেন, তারা দুজন গিয়ে দেখলেন ব্রিগেড কমান্ডারের চেয়ারে খালেদ মোশাররফ বসে আছেন। তার পাশে শাফায়াত জামিল। অন্য অফিসাররা দাঁড়িয়ে। তাদের দুজনকে বসতে দেওয়া হয়। তারা ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছের এ দুই সিনিয়র কর্মকর্তা তাদের লড়াই করার গাইডলাইন দেবেন। বলবেন খুনিদের প্রতিরোধ করার কথা। না, তারা পান বিপরীত নির্দেশ। তাদের বলা হয় কোনো ধরনের ঝামেলায় না জড়াতে। রক্ষীবাহিনীকে শান্ত রাখতে। রেডিও স্টেশনে গিয়ে আনুগত্য প্রকাশের নির্দেশও তাদের দেন খালেদ মোশাররফ ফোনে। তখন তোফায়েল আহমেদ ছিলেন রক্ষীবাহিনী অফিসে বসা। লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, শাফায়াত জামিল তার কাছে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তার সামনে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের খালেদ মোশাররফ বোঝাচ্ছিলেন। তিনি আরও বলেছেন, তিনি খালেদ মোশাররফের রুম থেকে বের হয়ে দেখেন খুনি ফারুককে। তার মুখে তৃপ্তির হাসি। ফারুককে ৪৬ ব্রিগেডের সেনা কর্মকর্তারা অভিনন্দন জানাচ্ছেন। জড়িয়ে ধরছেন। শাফায়াত জামিল অবশ্য হামিদের বক্তব্যের সঙ্গে পরে ভিন্নমত পোষণ করে বক্তব্য দিয়েছেন। লিখেছেন।

রেডিও স্টেশন থেকে মোশতাক ট্যাংকমিছিল নিয়ে বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন। কথা ছিল শুক্রবার জুমার পরে শপথ হবে খুনি সরকারের। পরে জুমার আগেই রেডিও স্টেশন থেকে সেনা কর্মকর্তাও দলবেঁধে বঙ্গভবন গিয়েছিলেন। তারা বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সবকিছু ঠিক রাখার। বঙ্গভবনে তারা ভারতের হামলার আশঙ্কায় কেন্দ্রীয় জরুরি সেল খোলেন। কেন এত নাটক? সিনিয়র কর্মকর্তাদের সমর্থন না পেলে ১৫ আগস্ট ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে উল্লাস আর আনন্দ করার সুযোগ ছিল না। লে. কর্নেল হামিদের মতে, সেনাবাহিনীর বসদের বোধোদয় হয় ১৯ আগস্ট। সকাল ৮টায় ব্রিগেড কমান্ডারদের বৈঠক ডাকলেন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ। কোনো ধরনের পদে না থেকেও বৈঠকে যোগ দেন খুনি ফারুক ও রশীদ দুই ভায়রাভাই। হামিদ লিখেছেন, ‘এর মধ্যে শাফায়াত জামিল বুঝে যান এ অভ্যুত্থানে তার কোনো লাভ হয়নি। তিনি বৈঠক শুরুর আগে সেনাপ্রধানের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন। তার সঙ্গে ছিলেন স্টাফ অফিসার হাফিজ উল্লাহ। শাফায়াত উত্তেজিতভাবে সেনাপ্রধানকে বললেন, সব বিশৃঙ্খলার পেছনে রয়েছেন জিয়াউর রহমান। শফিউল্লাহ তাকে উত্তর দিলেন, এ কথাটা বুঝতে তোমার এতদিন লাগল? এখন তো সব শেষ। ব্রিগেড কমান্ডারদের বৈঠকে ভারতীয় হামলার আশঙ্কা করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়া বিপথগামী সাধারণ সেনাদের ফেরত আনার দাবি তোলা হয়। শাফায়াত জামিল প্রথমবারের মতো শক্ত বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, তারা ফিরে না এলে আমি কঠোর ব্যবস্থা নেব। তিনি কোর্ট মার্শালেরও দাবি করেন।’

ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আস্থাবান একজন কর্মকর্তা। খালেদ মোশাররফও তাই ছিলেন। জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ১৫ আগস্ট ছিল খুনিদের পক্ষে। এ কারণে প্রশ্ন জাগে, খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিল কেন ব্যবস্থা নিলেন না? সেনাপ্রধান তো তাদের কাছে কাকুতিমিনতি করেছেন। সেনাপ্রধানের নির্দেশ অনুযায়ী ১৫ আগস্ট ভোরে তারা সেনাবাহিনীর আইন অনুযায়ী অ্যাকশনে গেলে আজকের ইতিহাস ভিন্ন হতো। সামরিক আদালত বসলে, খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা হলে আমাদের এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো না। খন্দকার মোশতাকের বাড়াবাড়ি জাতিকে সহ্য করতে হতো না। ইতিহাসের সিদ্ধান্ত মাহেন্দ্রক্ষণে নিতে হয়। খালেদ আর শাফায়াত এখানেই ভুল করেছেন। অধ্যাপক আবু সাইয়িদের মতে, তারা ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে ক্যু করেননি। তারা সব করেছেন চেন অব কমান্ড ঠিক করতে। খালেদ ক্ষমতায় থাকাকালে খুনিরা দেশ ত্যাগ করে। তাদের কেন দেশ ত্যাগ করতে দেওয়া হয়েছিল? প্রশ্ন অনেক, উত্তর নেই।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

মতামত