দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন রাজনীতিতে সমঝোতা হচ্ছে না

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন রাজনীতিতে সমঝোতা হচ্ছে না

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র চার মাস। বিগত দুটি সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনের সিদ্ধান্তে অনড় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ না হলে নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে শুরুতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে অবস্থান স্পষ্ট করা না হলেও সম্প্রতি কোনো কোনো দেশ থেকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে সরকারকে। কিন্তু এসব চাপ আমলে না নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও পাল্টা কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের অনড় অবস্থানের কথা তুলে ধরছেন। আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে সরকার খুব বেশি ভাবছে না, তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ফলে সার্বিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার আর কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরের বছর ৩০ জানুয়ারি বসে একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন। ফলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে কমিশনকে। সে ক্ষেত্রে ১ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা। কমিশন থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ভোটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসি। এ ক্ষেত্রে ৪ জানুয়ারিকে ভোট গ্রহণের দিন ধরেই সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। তার আগে নভেম্বরের শুরুতেই ভোটের তপশিল ঘোষণা হতে পারে। শনিবার এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোটের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নির্বাচনের জন্য ৪২ হাজার ৩৫০টি খসড়া ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে। গতবার ভোটকেন্দ্র ছিল ৪০ হাজার ১৮৩টি। এ মাসেই ভোটকেন্দ্র ও কক্ষ চূড়ান্ত করা হবে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে দুটি রাজনৈতিক দলকে চূড়ান্ত নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। ৬৮টি দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার খসড়া তালিকা করা হয়েছে। একাধিক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের জন্য খসড়া নীতিমালা করেছে কমিশন, যা আগামী কমিশন সভায় পাস করা হবে। গত শনিবার নির্বাচনের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতির ঘোষণা দিয়েছে ইসি। সব মিলিয়ে নির্বাচন সামনে রেখে পুরোদমে চলছে প্রস্তুতি।

এমন ডামাঢোলের মধ্যেও ভোট নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে দেশের মানুষ। কারণ নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে এখনো বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।

সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই হবে আগামী নির্বাচন—এমন অনড় অবস্থানে ক্ষমতাসীন দল ও তাদের মিত্ররা। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন ঠেকানোর শক্তি কারও নেই বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকেও তারা এ বার্তাই দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, ‘বিএনপি সংবিধানের বাইরে গিয়ে গণতন্ত্র নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করছে। এটি কোনোভাবেই হতে দেওয়া হবে না।’

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, জাতীয় পার্টি (জেপি, মঞ্জু), তরীকত ফেডারেশনসহ বাকি দলগুলোর অবস্থানও একই। তাদের দাবি, কোনোভাবেই সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। এ অবস্থানের পক্ষে জনমত তৈরি করতে রাজপথে নানা কর্মসূচি পালন করছে ক্ষমতাসীন দল ও জোট।

অন্যদিকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপিসহ সমমনা ৩৬টি দল। সরকার পদত্যাগে একদফা দাবিতে ইতোমধ্যে রাজপথের আন্দোলন জোরদারে ব্যস্ত তারা। নির্দলীয় সরকার ছাড়া কোনো ভোট হতে দেওয়া হবে না বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিদেশিদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় বিএনপি। নিজেদের দাবির পক্ষে জনমত তৈরি করতে রাজপথে নানা কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি ও মিত্র দলগুলো।

নির্বাচন নিয়ে ইসির প্রস্তুতির সমালোচনা করে শনিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘যে ভোটাধিকারের জন্য মানুষ সংগ্রাম করছে, তা পুনরুদ্ধার না করা পর্যন্ত এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। সরকার মানুষকে বোকা ভাবছে। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করলেই নির্বাচন হয়ে যাবে, এত সহজ নয়।’

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে রয়েছে আ স ম আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চ। তবে দাবি ও কর্মসূচিতে সামঞ্জস্য থাকলেও বিএনপির সঙ্গে যুগপতে নেই সিপিবি ও বাসদ।

অন্যদিকে নিজেদের অবস্থান সুস্পষ্ট না করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। নির্বাচনের জন্য নিজস্ব একটি ফর্মুলার প্রস্তাবও করেছেন তারা। তবে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না—এমন কোনো ঘোষণা দেননি দলটির নীতিনির্ধারকরা। সম্প্রতি ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখনো সময় আসেনি। আরও কিছুদিন দেখেশুনে তারপর করণীয় ঠিক করব। আর নির্বাচন বর্জন করব, এটা কিন্তু আমরা কোনোদিন বলিনি। তবে আমরা চাইব নির্বাচনটা যাতে ভালো হয়।’

এর বাইরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ইসলামী আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থি কয়েকটি দল মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

রাজনৈতিক দলগুলোর এমন অবস্থানের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে। সর্বশেষ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা ইস্যুতে বিদেশিদের দেওয়া বিবৃতির সঙ্গে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

তবে সরকার দেশি-বিদেশি কোনো ধরনের চাপকেই আমলে নিচ্ছে না। মঙ্গলবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অংশগ্রহণ বলতে কাদের অংশগ্রহণ? ভোট চোরদের, ভোট ডাকাতদের? দুর্নীতিবাজ, টাকা পাচারকারী, খুনি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারী, জাতির পিতার হত্যাকারী, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, তাদের অংশগ্রহণ? এটা কি জনগণ চায়? তারা অংশ নিলেই নির্বাচন বৈধ হবে, অন্যরা অংশ নিলে নির্বাচন বৈধ হবে না—এটা তো হতে পারে না।’

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মহলের আলোচনার বিষয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমার কাছে অংশগ্রহণ মানে জনগণের অংশগ্রহণ। যতগুলো উপনির্বাচন হলো, স্থানীয় নির্বাচন হলো, জনগণ কি অংশ্রগ্রহণ করেনি? জনগণ তো অংশগ্রহণ করেছে, সেটাই তো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলো।’

নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে বিএনপি নেতাদের সমালোচনার জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বিএনপি নেতারা নির্বাচনের তপশিল নিয়ে হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। এই বক্তব্য বিএনপির ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখলের অপতৎপরতার বহিঃপ্রকাশ।’

কোনো নির্দিষ্ট দলের জন্য নির্বাচন থেমে থাকে না বলেও মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বড় বড় রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির বিপরীতমুখী কঠোর অবস্থানের ফলে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আগামী নির্বাচন নিয়ে সংলাপ বা সমঝোতার সম্ভাবনা একবারেই ক্ষীণ হয়ে গেছে।

তারা মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমে কোনো সমঝোতা না হলে বিরোধী দলগুলো রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবি আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। আর সরকারি দলও তাদের অবস্থান বজায় রাখতে রাজপথে অবস্থান জোরালো করতে চাইবে। এতে সংঘাতের আশঙ্কা আরও বাড়বে। এমন পরিস্থিতি দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য সুখকর হবে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। বড় দুই দলকে ছাড়ের মানসিকতা নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। তাহলে একটা সমাধানের পথ বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সংলাপ না হলে এ সংকট আরও ঘনীভূত হবে, যা কোনোভাবেই দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য সুখকর হবে না।’

সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘দুই দল প্রকৃতপক্ষে দেশি ও বিদেশি বড় বড় ব্যক্তি ও দেশের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় লিপ্ত। তারা বড়লোকদের পক্ষের শক্তি। জনগণের পক্ষের নয়। বাম গণতান্ত্রিক দলগুলো সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিকল্প শক্তি সমাবেশের মাধ্যমে এই লুটেরা ও দুর্বৃত্তদের অবসানের সংগ্রাম করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত লুটেরাদের অবসান না ঘটবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিজেদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি চলতেই থাকবে, সমঝোতা হবে না।’

রাজনীতি শীর্ষ সংবাদ