খোলাবাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় নগদ ডলারের দাম আবার বেড়েছে। ডলারের দাম নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেকে বেশি রাখছে—এই অভিযোগে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। অভিযানের ভয়ে রাজধানীর বেশির ভাগ মানি এক্সচেঞ্জ ডলার ছাড়ছে না। এতে ডলারসংকট চলছে।
চাহিদামতো ডলার না পেয়ে এক মানি এক্সচেঞ্জ থেকে অন্য মানি এক্সচেঞ্জে হন্যে হয়ে ঘুরছে মানুষ। অন্যদিকে আন্ত ব্যাংক লেনদেনে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দরে উঠেছে মার্কিন ডলার।
ঢাকার গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বরে ল্যান্ডমার্ক শপিং সেন্টারে কর্নিকা মানি এক্সচেঞ্জে ৫০০ ডলার চাচ্ছিলেন লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ফাহিম রাশেদ শেখ। মানি এক্সচেঞ্জটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমান বললেন, ‘ডলার নেই, অপেক্ষা করতে হবে।
যদি কেউ বিক্রি করে, তাহলে ১০০ ডলার দেওয়া যাবে।’ গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে কর্নিকায় চলছিল গোয়েন্দা সংস্থার তদারকি। ডলারের দর কত জানতে চাইলে আতাউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ১১১ টাকায় কিনে ১১২ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করছি।’ এমন অবস্থা দেখা গেছে রাজধানীর আরো কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জে।
রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, বায়তুল মোকাররম এলাকার ডলার কোনাবেচায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরবরাহ কমে যাওয়ায় নগদ ডলারের দাম বাড়তি। রাজধানীর খোলাবাজারে গত সপ্তাহে ডলার বিক্রি হয়েছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকার মধ্যে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী, এখন নগদে প্রতি ডলারের দাম ১১২ টাকা ৫০ পয়সার মধ্যে থাকার কথা।
জানতে চাইলে মানি চেঞ্জারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব শেখ মো. হেলাল সিকদার গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কেউ কেউ ডলারের বাজার অস্থির করার অপচেষ্টা চালাতে পারেন। অযথা কেউ যাতে নির্ধারিত দামের বাইরে ডলার বিক্রি করতে না পারেন, সে জন্য আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সহযোগিতা করছি।
ভিসা ও ভ্রমণ টিকিট ছাড়া ডলার দেওয়া হচ্ছে না। তবে বাজারে ডলারের সরবরাহে সংকট আছে, কম পাওয়া যাচ্ছে। আমরা যদি কিনতে না পারি, তাহলে ডলার বিক্রি করব কিভাবে? অনেকে ডলারের উচ্চ দাম পাওয়ার আশায় ডলার ধরে রাখছে।’
শেখ মো. হেলাল সিকদার বলেন, ‘বেশি দাম যারা নিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিছু অবৈধ মানি চেঞ্জার অভিযানের ভয়ে কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। দোকান ছাড়াও হজ এজেন্সি, ট্রাভেল এজেন্সির অফিসেও অবৈধভাবে ডলারের লেনদেন হচ্ছে। আশা করি শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’
তিনি জানান, গত জুলাই ও আগস্ট মাসে ডলার কেনার ব্যাপক চাহিদা ছিল। এ সময় অনেকে বিদেশভ্রমণের জন্য গেছেন। আবার শিক্ষার উদ্দেশ্যে অনেকে বিদেশে গেছেন। তাঁদের প্রায় সবাই নগদ ডলার সঙ্গে করে নিয়েছেন। ফলে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে।
গত বছরের জুনে ডলার নিয়ে অস্থিরতার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, অনুমোদিত ২৩৫টির বাইরে আরো ৭০০টির মতো মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে।
অভিযানের ভয়ে লেনদেন বন্ধ
খোলাবাজারে ডলার বিক্রিতে অনিয়ম রোধে আবার অভিযানে নেমেছে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি করায় সম্প্রতি সাত মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই কারণে আরো ১০ মানি চেঞ্জারের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। অভিযানের ভয়-আতঙ্কে মানি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো ডলার বেচাকেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে খোলাবাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে।
আন্ত ব্যাংকে সর্বোচ্চ ডলারের দাম
দেশের আন্ত ব্যাংক লেনদেনে গতকাল ডলারের দাম উঠেছে ১১০ টাকায়। গত বৃহস্পতিবার আন্ত ব্যাংকে টাকার বিপরীতে প্রতি ডলারের দর ছিল ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৯৫ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ মে প্রথমবারের মতো আন্ত ব্যাংকে ডলারের দর উঠেছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। এরপর সামান্য কিছু বেড়ে ১০৮ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত উঠে ফের ১০৮ টাকা ৫০ পয়সায় নেমে অবস্থান করছিল মে মাসের শেষের দিকে।
আন্ত ব্যাংকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই লেনদেন ব্যয়ও বাড়বে। কারণ ডলারের দরের সঙ্গে ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে কমিশন আকারে ১০ থেকে ৫০ পয়সা পর্যন্ত যোগ করে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে ডলারের দর আরো বাড়ে। এতে পণ্য আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বর্তমানে আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও নগদ বিক্রিতে ডলারের দর ভিন্ন ভিন্ন। ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার একাধিক দর না রেখে একক দর নির্ধারণ করার। পরামর্শ মেনে আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও নগদ কেনাবেচায় বিদেশি মুদ্রার একাধিক বিনিময়হারকে একটিতে নামিয়ে আনার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কঠোর অবস্থানে বাংলাদেশ ব্যাংক
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারে ডলারের সংকট নেই। অতিরিক্ত দামে কেউ যদি ডলার বিক্রি করে, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকে গেলে ডলার পাওয়া যাবে। অতিরিক্ত দামে ডলার বিক্রির কারণে ১৩টি ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
মানি চেঞ্জারগুলোর ডলার বিক্রি না করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, মানি চেঞ্জারগুলো একজনের কাছ থেকে কিনে অন্যজনের কাছে বিক্রি করে। যদি কেউ ১১২ টাকার নিচে ডলার বিক্রি না করে তাহলে মানি চেঞ্জারগুলো ডলার না পেলে তারা বিক্রি করতে পারবে না।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডলারের যে রেটটা ছদ্মবেশে আছে, সেটা উন্মুক্ত হবে। তাহলে বাজারের স্বচ্ছতা বাড়বে। এখনো ডলারের সংকট রয়ে গেছে বলেই এলসি নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের জোগান বাড়াতে হলে বিনিময়হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছাড়তে হবে।’