জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ আগের অবস্থানে অনড় রয়েছে। সংবিধানের আলোকেই আগামী নির্বাচন করতে চায় ক্ষমতাসীনরা। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি কূটনীতিকদের চাপ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধী পক্ষের একদফার আন্দোলন আমলে নিচ্ছে না সরকার। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শেষে চলতি মাসের শেষ নাগাদ দেশে ফিরে আসবেন। এরপর দলের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করবেন। আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা যুগান্তরকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে ৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দিল্লি যাওয়ার কর্মসূচি রয়েছে। এ সফর সম্পর্কে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈঠকে বসবেন। এ বৈঠকে তিস্তাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দুই সরকারপ্রধানের আলোচনা হবে।
তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা-শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির এ বৈঠকের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় হবে বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থান পরিবর্তনে বন্ধুপ্রতিম দেশটির সহযোগিতা চাইতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভারতের নয়াদিল্লিতে জি-২০ সম্মেলন শেষ করে দ্রুতই দেশে ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও মঙ্গলবার এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এরপরও তার সফরসঙ্গীরা ধারণা করছেন, ১০ সেপ্টেম্বর রোববারের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে। ওইদিনই ঢাকা সফরের কর্মসূচি রয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর। তিনিও দিল্লি থেকে আসবেন।
চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় নাগাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ সফর কর্মসূচি রয়েছে, তা হচ্ছে নিউইয়র্ক যাত্রা। সেখানে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। অন্য সময় যুক্তরাষ্ট্রে শেখ হাসিনা তার জন্মদিন (২৮ সেপ্টেম্বর) পালন করলেও এবার সেসময় দেশে থাকার পরিকল্পনা করছেন। অর্থাৎ ২৮ সেপ্টেম্বরের আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসবেন বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে। এরপর সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করবেন তিনি। তবে এখন পর্যন্ত তারিখটি চূড়ান্ত হয়নি।
বর্তমান সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষের পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ওই সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ৩০ জানুয়ারি। তাই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সে হিসাবে ১ নভেম্বর থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হচ্ছে। সূত্র বলছে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে।
অবশ্য এখন পর্যন্ত নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে কোনো আলোচনা বাইরে আসেনি। যদিও বর্তমান মন্ত্রিসভার অনেকে মনে করছেন, তাদেরকে সর্বোচ্চ ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্বে রাখা হতে পারে। এরপর ছোট আকারে নির্বাচনকালীন একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করেন, নিশ্চয় এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একদফার আন্দোলন আরও বেগবান করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা। কিন্তু এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিরোধীদের কোনো আন্দোলন কর্মসূচিকে পাত্তা দিচ্ছে না। ক্ষমতাসীনরা মনে করে, বিএনপি এবং তার মিত্ররা আন্দোলন চালিয়ে যাক। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে পুরো দেশকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে ঠেলে দেবে। এরপর নির্বাচনি ডামাডোলে দেশজুড়ে একধরনের প্রচার-প্রচারণা জোরদার হয়ে যাবে। ওই অবস্থায় বিএনপির আন্দোলন হালে পানি পাবে না।
সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, জি-২০ সম্মেলন থেকে ফিরে আসার পর তারা পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে স্পষ্ট বার্তা দিতে পারবেন। তাদের ধারণা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত সবুজ সংকেত নিয়ে আসবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর চলতি মাসে আরেক সফরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দফারফায় উপনীত হতে পারবেন তিনি। ফলে বিএনপির আন্দোলন এবং বিদেশি চাপ কাটিয়ে বর্তমান সংবিধানের আলোকে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে।
বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এই সময়ে নির্বাহী প্রধান হিসাবে রুটিনমাফিক তার কাজ করবেন। সংবিধানের ৫৭(৩) ধারায় বলা আছে, প্রধানমন্ত্রী একজন নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। আওয়ামী লীগ চাচ্ছে, সংবিধানের এ নির্দেশনা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দায়িত্ব পালন করবেন নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানের। তার অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তারা কোনোভাবেই বিএনপিসহ তাদের মিত্রদের চলমান আন্দোলনে নতি স্বীকার করবে না। প্রয়োজনে বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন আয়োজন করবে সরকার। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার জন্য তাদের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে বেশকিছু রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কোনো ছাড় দেবে না। আমরা সংবিধান সমুন্নত রাখতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যে কোনো অপচেষ্টা প্রতিহত করব।
আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, গণতন্ত্রকে সংহত করার জন্য দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির নির্বাচনে আসা উচিত।
যদি নাও আসে, জনগণ ব্যাপকভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন প্রতিহত করার ক্ষমতা বিএনপির নেই। ২০১৪ সালে আমরা তাদের মোকাবিলা করেছি। সেই পরিস্থিতি বিএনপি কখনোই তৈরি করতে পারবে না। নির্বাচনে তারা না এলেও অনেক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে।
আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু তাদের এই আন্দোলন হালে পানি পায়নি। সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়েই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা রাজনীতির চিরায়ত উক্তি উচ্চারণ করে বলেন, রাজনীতিতে সত্যিই শেষ কথা বলে কিছু নেই। অর্থাৎ আমরা খোলা চোখে যা দেখছি, শুনছি এবং বলছি-এটাই পুরো চিত্র না। এর বাইরেও অনেক কিছু থাকতে পারে। সেটি দেখার জন্য সময় ও পরিস্থিতি বড় একটি ফ্যাক্টর। অবশ্য এ কথাও সত্য-বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে সহজে টলানো যাবে না। দেশের স্বার্থে তিনি কারও কাছে মাথানত করবেন না। নিশ্চয় দেশবাসী ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সাহসী বক্তব্য থেকে এর প্রমাণ পেয়েছে। অতএব আওয়ামী লীগকে ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না।