কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টম হাউসের গুদাম থেকে ৫৫ কেজি সোনা চুরি হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনায় জড়িত তিনজনকে চিহ্নিত করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। শিগগিরই তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হবে। চিহ্নিত ওই তিনজন হচ্ছেন কাস্টমস কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম শাহেদ ও শহীদুল ইসলাম এবং ভল্টের নিরাপত্তাকর্মী সিপাহি নিয়ামত হাওলাদার।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, ২০২০ সাল থেকে ধাপে ধাপে লকার থেকে এসব সোনা সরানো হয়েছে। চুরি করা সোনার বেশির ভাগই তাঁরা বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেছেন। ওই দোকানগুলোকেও শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। চুরিতে আরো কয়েকজনের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
তা ছাড়া মামলার এজাহারে অনেক ভুল তথ্যও দেওয়া হয়েছে।
সোনা চুরির ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় রবিবার রাতে কাস্টম হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। এরপর থানা পুলিশ মামলার তদন্ত শুরু করে। এ ঘটনায় শুল্ক বিভাগের একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
গতকাল মামলাটি তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি)। মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সোনা চুরির ঘটনায় জড়িত তিনজনকে সশনাক্ত করেছেন তাঁরা। আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। ঘটনা আড়াল করতে কাস্টমসেরই আরো কোন কোন কর্মকর্তা তাঁদের সহযোগিতা করেছেন, চুরি করা স্বর্ণালংকার তাঁরা কোথায় বিক্রি করেছেন, সেই টাকা কী করেছেন—এমন বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছেন তাঁরা। সহযোগিতাকারীদেরও এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দরের চুরি যাওয়া ওই ভল্টের দায়িত্বে ছিলেন শহিদুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলম শাহেদ। সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ আদেশে তাঁদের দুজনকে বদলি করে একই পদমর্যাদার আকরাম ও মাসুমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু শহিদুল ও শাহেদ গুদামে সংরক্ষিত সামগ্রীর হিসাব নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত আকরাম ও মাসুমকে বুঝিয়ে দিতে টালবাহানা করেন। ঢাকা কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার লুবানা ইয়াসমিন গত ২১ আগস্ট শহিদুল ও শাহেদের বদলির আদেশ গুদামের মূল্যবান সামগ্রী বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেন। এরপর বিষয়টি আড়াল করতে তাঁরা চুরির নাটক সাজান।
পুলিশ সূত্র জানায়, এঁদের একটি চক্র আছে। এঁরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে স্বর্ণ জমা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে তালিকা জমা দেন। তাঁদের দেওয়া তালিকা ধরে বিভিন্ন সময়ে অনেক স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা দেওয়া হয়। তবে কিছু সোনা দীর্ঘদিন ধরে গুদামে থাকলেও তার কোনো তালিকা তাঁরা দেননি। ৫৫ কেজি স্বর্ণ চুরির পর এ বিষয়টি ধরা পড়ে।
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) তৌহিদুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ঘটনায় করা মামলাটি এরই মধ্যে (মঙ্গলবার) ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা মামলার তদন্ত করবে। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) এবং গুদামের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা চার সিপাহিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেওয়া হয়। এঁদের মধ্যে তিনজনের ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এই ঘটনায় গত রবিবার রাতে মামলা হওয়ার পর থেকেই তদন্ত শুরু করে সন্দেহভাজনদের ওপর নজর রাখছিলেন তাঁরা। গুদাম থেকে স্বর্ণ চুরির বিষয়টি শুল্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ১৫ দিন আগেই টের পেয়েছিলেন। এর পরই গুদামে রক্ষিত মালপত্র কাগজপত্রের হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন তাঁরা। এরপর গত শনিবার হঠাৎ একটি লকার ভাঙার পর তাঁরা চুরির ঘটনাটি নিশ্চিত হন।
সূত্র জানায়, তদন্তে এ পর্যন্ত গুদামের বাইরের পাঁচটি তালা অক্ষত পাওয়া গেছে। আর গুদামের ভেতরের যে লকারটি ভাঙা পাওয়া গেছে, তার পাশে একটি কাটার পাওয়া গেছে, যা দিয়ে গুদামের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের একটি অংশ কেটে রাখা হয়। মূলত বাইরে থেকে চোর গুদামে ঢুকেছে, এমনটা দেখাতে চুরির নাটক সাজানো হয়।
এদিকে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১৫ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন আদালত। গত সোমবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল হুদা চৌধুরী মামলার এজাহার গ্রহণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ দিন ধার্য করেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধারণা করছেন, বিমানবন্দরের কাস্টম হাউস থেকে সোনা চুরির ঘটনায় কাস্টম হাউসের অডিট শুরু হওয়ার কারণে চুরির নাটক সাজানো হয়েছিল। এর আগে ২০১৯ সালে বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকেও একই কায়দায় প্রায় ২০ কেজি সোনা ও স্বর্ণালংকার গায়েব করা হয়।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোর্শেদ আলম বলেন, ‘এখানে কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই যেতে পারেন। আমাদের কাছে যে তথ্য-উপাত্ত আছে, সেখানে বাইরে থেকে কেউ এসে সোনা নিতে পারবে না।’
ঢাকা কাস্টমসের প্রিভেন্টিভ টিমের ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ মোকাদ্দেস হোসেন বলেন, ঘটনায় যাঁরা দোষী তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে।
ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা আজাদ বলেছেন, আট দিন আগে গুদামটিতে অটোমেশনের কাজ শুরু হয়। এই কাজের অংশ হিসেবে গুদামে থাকা সোনা গণনার কাজ শুরু হয়। সোনা চুরির ঘটনা আগেই ঘটেছে।
এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, চুরির বিষয়টিতে গোয়েন্দা পুলিশ ছায়াতদন্ত করছে। একাধিক টিম কাজ করছে। কারা কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাঁদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।