রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের অঢেল ঋণের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে গ্রুপটিকে মূলধনের প্রায় ১০ গুণ ঋণ দিয়ে সে তথ্য গোপন রাখে ব্যাংকটি। বিধি অমান্য করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠানকে সীমার অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ করা হয়। প্রভাবশালী এ গ্রাহককে সুবিধা দিতে সরকারি ব্যাংকগুলোর সাথে করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমঝোতা চুক্তিও মানতে চাইছে না জনতা ব্যাংক।
সম্প্রতি বেক্সিমকোর ২৯টি প্রতিষ্ঠানের ঋণের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা যায় ২৬টি প্রতিষ্ঠানই নির্ধারিত ঋণ সীমা লঙ্ঘন করেছে। এতদিন গ্রুপটির মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়ে আসছিল জনতা ব্যাংক। বাকি ২৫টি প্রতিষ্ঠানের ঋণের তথ্য গোপণ রাখে ব্যাংকটি। সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বহুল সমালোচিত অ্যানন টেক্স গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির মূল হোতা আবদুছ ছালাম আজাদ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য গোপন রাখেন। সম্প্রতি তিনি অবসরে গেলে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রের তথ্য মতে, জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিস, ঢাকা শাখার গ্রাহক বেক্সিমকো লি., বেক্সিমকো ফার্মা লি. এবং ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লি. ও ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লি. ইউনিট-২-এর ঋণ সুবিধার ক্ষেত্রে একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রমণে অনাপত্তি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু অনাপত্তির আবেদনের সময় ব্যাংকটি বেক্সিমকো গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ঋণের তথ্য গোপন রাখে। এতে গ্রুপটির বিপুল ঋণের তথ্য আড়ালে থেকে যায়। একই সাথে গ্রুপ হিসেবে একক গ্রাহক ঋণ সীমা তথা ব্যাংকের মূলধনের তুলনায় গ্রুপের সমুদয় ঋণের তথ্য গোপন থাকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রভাবশালী গ্রাহককে বিশেষ সুবিধা দিতে পরিকল্পিতভাবে তথ্য গোপন করছিল জনতা ব্যাংক। তারা নিশ্চিত হয়েছেন, সাবেক এমডি আবদুছ ছালাম আজাদের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে তথ্য গোপন করছিল। নাম প্রকাশ না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিষয়টি এমন নয় যে, এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানত না। জনতা ব্যাংক গ্রাহক ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে তথ্য আদান-প্রদান করেছে। কিন্তু সবগুলো প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপের তা তারা অনাপত্তির আবেদনের সাথে সংযুক্ত করেনি। তাহলে একক গ্রুপের কাছে থাকা ঋণের তথ্য বেড়িয়ে আসত। কৌশলে বিষয়টি গোপন করা হচ্ছিল।’
তিনি বলেন, একটি গ্রুপের কাছে এত ঋণ থাকা কোনো ব্যাংকের জন্যই নিরাপদ নয়। কারণ এখানে প্রায় সবই গ্রাহকের টাকা। মূলধনের তুলনায় ঋণ প্রায় ১০ গুণ। বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন জানত না যে, জনতা ব্যাংক একটি গ্রুপকে এত ঋণ দিচ্ছে। এখন তাদেরকে আইনের মধ্যে আনতে ছাড় দেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। সময় বেঁধে দিয়ে অনাপত্তি দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সীমা অনুসরণে বাধ্য করাই এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত।’
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ১৮ জুলাই জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৭৭৬তম সভায় বেক্সিমকো গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৪৭৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন হয়। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ অনুমোদনে আইনগত বাধা রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনাপত্তি চাওয়া হয়। যদিও দুটি প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই সীমা অতিক্রম করেছিল কিন্তু ব্যাংক অনাপত্তি গ্রহণ করেনি। অনাপত্তি আবেদন পর্যালোচনা করে বেরিয়ে আসে বেক্সিমকো গ্রুপের নতুন তিন প্রতিষ্ঠানের তথ্য।
এগুলো হলো— ক্রিসেন্ট ফ্যাশনস অ্যান্ড ডিজাইন, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ ও শাইনপুকুর গার্মেন্টস। এর পরিপ্রেক্ষিতে গ্রুপটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধান শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জনতা ব্যাংকের বোর্ড মেমো পর্যালোচনা করে মোট ২৯টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২৬টি প্রতিষ্ঠানই একক গ্রাহক ঋণসীমা লঙ্ঘন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মোট দায় জনতা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সাড়ে ৯ গুণ। অর্থাৎ বেক্সিমকো গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকটির মূলধনের চেয়ে ৯৫০ শতাংশ অর্থ ঋণ হিসেবে নিয়ে গেছে। টাকার অংকে এর পরিমাণ ২১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। আর জনতা ব্যাংকের মূলধন রয়েছে দুই হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। সে হিসেবে সাধারণ গ্রাহকের আমানতের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বেক্সিমকোকে দিয়েছে জনতা ব্যাংক। যা এতদিন গোপন ছিল।
গোপন তথ্য সামনে আসার পর যে ২৬টি প্রতিষ্ঠান একক গ্রাহক ঋণসীমা লঙ্ঘন করে এতদিন ঋণ নিচ্ছিল তার আইনগত বৈধতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদনের সিদ্ধান্ত নেয় জনতা ব্যাংকের ৭৭৮তম বোর্ডসভা। সে মোতাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করে ব্যাংকটি। আবেদনে একক গ্রাহক ঋণসীমা লঙ্ঘনে অনাপত্তির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপুল ঋণ পুনঃতফসিলেও আইনগত ছাড় চাওয়া হয়।
আর্থিক খাতে সৃষ্ট অস্থিরতা মোকাবিলায় ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর সাথে সমঝোতা চুক্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রভাবশালী গ্রাহককে বিশেষ সুবিধা দিতে এই সমঝোতা মানতে চাচ্ছে না জনতা ব্যাংক। চুক্তি অনুযায়ী সব গ্রাহকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই শর্ত ভঙ্গ করে প্রভাবশালী গ্রাহককে ঋণ পুনঃতফসিলে বিশেষ সুবিধার আবেদন নাকচ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে অদৃশ্য চাপে একক গ্রাহক ঋণসীমা সংক্রান্ত শর্ত শিথিল করা হয়। অন্যদিকে দীর্ঘ দিন ধরে গ্রুপটির বিপুল ঋণের তথ্য গোপন রাখায় জনতা ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
আমার সংবাদের হাতে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, জনতা ব্যাংক কর্তৃক বেক্সিমকো গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের তথ্য গোপনের বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তারা শনাক্ত করেছেন। এতে বলা হয়, ‘ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লি. ও ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লি. ইউনিট-২ এর ঋণসুবিধা একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনাপত্তির জন্য আবেদন করার সময় জনতা ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দায়-দেনার পরিপূর্ণ হিসাব পাঠানো হয়নি। তখন কেবল ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লি. ও ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লি. ইউনিট-২ এই দুটি প্রতিষ্ঠানের দায়-দেনার হিসাব পাঠানো হয়। বর্তমানে গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দায়-দেনার হিসাব পাঠানোর পর দেখা যায় ব্যাংকে বেক্সিমকো লি. ও এর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ফান্ডেড দায় রয়েছে ২১ হাজার ৬১২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা এবং মোট দায় ২১ হাজার ৯৭৮ কোটি তিন লাখ টাকা।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি ঘোষণা করে, কিন্তু তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ব্যাংকের বোর্ডের। যেহেতু বিষয়টি সামনে এসেছে তাই জনতা ব্যাংকের বোর্ড এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। ব্যাংকটির বোর্ড একটি আইনের মধ্যেই গঠিত হয়েছে।’ তিনি বলেন, যদি জনতা ব্যাংক মনে করে ২২ হাজার কোটি নয়; বরং আরও বেশি টাকা একজন গ্রাহককে দেয়ার সক্ষমতা তাদের রয়েছে; আইন-কানুন মেনে দিতে পারে, তাহলে আমাদের কিছু বলার নেই। সীমা অতিক্রমণে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় জরুরি পণ্য আমদানির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ছাড় দিতে সরকারের অনেক নির্দেশনা থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনাপত্তি দেয়ার ক্ষেত্রে হয়তো সেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েছে।’
আইন অনুযায়ী, একক কোনো গ্রাহককে যেকোনো ব্যাংক মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। বর্তমানে জনতা ব্যাংকের মোট মূলধন দুই হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী কোনো একজন গ্রাহক জনতা ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ৫৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার বেশি ঋণ পেতে পারেন না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেক্সিমকো গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানই জনতা ব্যাংকের মূলধনের ৭২ শতাংশ ঋণ নিয়েছে। অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে যথাক্রমে ৫৫ ও ৩৪ শতাংশ ঋণ। তথ্য অনুযায়ী, ক্রিসেন্ট ফ্যাশনস অ্যান্ড ডিজাইন লি.-এর ফান্ডেড দায়ের পরিমাণ এক হাজার ২৯৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা ব্যাংকের মোট মূলধনের ৫৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লি. ও ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লি. ইউনিট-২-এর ফান্ডেড দায়ের পরিমাণ এক হাজার ৬৬৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, যা ব্যাংকের মূলধনের ৭২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। এ ছাড়া নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের ফান্ডেড দায়ের পরিমাণ ৭৮৮ দশমিক ২২ কোটি টাকা, যা ব্যাংক মূলধনের ৩৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী গ্রাহকদের ঋণগুলো ‘অসঙ্গতিপূর্ণ বা নন কনফার্মিং’ হয়ে পড়েছে। আইন অনুযায়ী কোনো গ্রাহকের ঋণ অসঙ্গতিপূর্ণ হলে তাকে নতুন ঋণ দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে ঋণ অনুমোদনের মাধ্যমে আইন লঙ্ঘন করেছে জনতা ব্যাংক।
এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল জব্বার লিখিত প্রশ্নের উত্তর দেননি। তার কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে মন্তব্য চাইলেও তিনি প্রতিবেদকের সাথে সাক্ষাত করেননি। তবে বেক্সিমকো বিষয়ে গণমাধ্যমে দেয়া এক বক্তব্যে তিনি জানিয়েছেন, গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট ঋণ নিয়মিত রয়েছে। তাই গ্রুপটির ঋণ নিয়ে জনতা ব্যাংক চিন্তিত নয়। ব্যাংকাররা বলছেন, সম্প্রতি ঋণ শ্রেণিকরণের শর্ত শিথিল করে ব্যাংকগুলোর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো ঋণ শ্রেণিকরণ, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করছে ব্যাংকগুলো। এই সুযোগ ব্যবহার করে বড় গ্রুপের ঋণগুলো কৌশলে নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমার সংবাদের প্রশ্নের উত্তর দেননি ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুছ ছালাম আজাদ। তার মুঠোফোনে বারবার কল করলেও তিনি সাড়া দেননি। এরপর হোয়াটস অ্যাপে লিখিত বার্তা পাঠিয়ে মন্তব্য চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি উত্তর দেননি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নিয়ম লঙ্ঘন করে অ্যাননটেক্স গ্রুপকে বিপুল ঋণ দেয়ার কারণে জনতা ব্যাংকের তৎকালীন এমডি আবদুছ ছালাম আজাদকে অপসারণের সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তদল। কিন্তু তিনি অপসারণতো হনইনি উল্টো এক্সটেনশন পেয়েছিলেন। যারা তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে তারাই পরবর্তীতে সুবিধা নিয়েছে, এটিই স্বাভাবিক। তবে রাষ্ট্রের একটি ব্যাংকের দায়িত্বে থেকে এভাবে ব্যক্তি স্বার্থে কাজ করা পেশাদারিত্ব, নৈতিকতা ও দেশপ্রেম সব কিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ক্ষমতার দাপটে অপরাধিরা এভাবে পার পেয়ে গেলে অনিয়ম আরও উৎসাহিত হয়। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা যখন কিছু মানুষের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও কিছু করার থাকে না। মেধাবী ও সাহসী অফিসাররা অনিয়ম বের করে প্রতিবেদন জমা দেন। তারা জীবন ও চাকরির ঝুঁকি নিয়ে দেশপ্রেমের জায়গা থেকে এসব করেন। কিন্তু পরবর্তিতে যখন অপরাধিদের শাস্তি হয় না; তখন তারা মানষিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং সাহস হারিয়ে ফেলেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যাংক খাতে নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে বা তথ্য গোপন করাসহ সংশ্লিষ্ট রীতিনীতি লঙ্ঘন করে ঋণ সুবিধা প্রদান কোনো নতুন ঘটনা নয়। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাও যথাযথ নয়। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ভূমিকার স্থলে খেলাপি ঋণের প্রাতিষ্ঠানিকীরণের মূল অনুঘটকদেরই সুরক্ষা দেয়ার তৎপরতায় লিপ্ত হওয়ার অভিযোগও এই প্রথমবার, তাও নয়। তিনি বলেন, খাদের কিনারা থেকে ব্যাংক খাতকে ফিরিয়ে আনতে হলে এক দিকে যেমন রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাংকে জবাবদিহিমূলক সুশাসন অপরিহার্য, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও শুদ্ধাচার চর্চা এবং সব প্রকার অনুকম্পা বা ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে নিয়ন্ত্রক হিসেবে জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে যথাযথ ভূমিকা পালনে তৎপর হতে হবে।
একটি ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের এ ঋণের বিষয়ে আমার সংবাদের পক্ষ থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের বক্তব্য জানার চেষ্টা করা। গ্রুপটির জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান ইমপ্যাক্ট পিআরের মাধ্যমে পাঠানো লিখিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। গতকাল সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বেক্সিমকো থেকে কোনো উত্তর আসেনি বলে জানিয়েছে ইমপ্যাক্ট পিআর।
গ্রুপটির কাছে প্রশ্ন ছিল— বেক্সিমকো গ্রুপের ২৯টি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। কিন্তু এতদিন চারটি ছাড়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য গোপন করা হয়েছিল। ফলে একটি গ্রুপের কাছে জনতা ব্যাংকের মূলধনের প্রায় ১০ গুণ অর্থ ঋণ হিসেবে চলে যায়। গ্রুপের ২৬টি প্রতিষ্ঠান ‘একক গ্রাহক ঋণসীমা’ লঙ্ঘন করেছে। এমনকি গ্রুপটির মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের মূলধনের সমপরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে নিয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে কিংবা ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এরূপ অস্বাভাবিক ঋণ নিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ। অন্যদিকে সমপ্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত বেক্সিমকো গ্রুপের একটি বক্তব্যে দাবি করা হয়েছে গ্রুপটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অর্ধশতাধিক। বাস্তবে গ্রুপটির স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত সংখ্যা কত। ২৯টি প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানসমূহের জনতা ব্যাংকে ঋণ আছে কি-না। একই সঙ্গে জানতে চাওয়া হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নিয়ম ‘বাস্তবসম্মত নয়’ বলে উল্লেখ করেছে বেক্সিমকো গ্রুপ। এর মাধ্যমে গ্রুপটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার আইনকে চ্যালেঞ্জ করছে কি-না।
এসব প্রশ্নের উত্তর না দিলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে গ্রুপটির ভাইস প্রেসিডেন্ট সালমান এফ রহমান জানান, জনতা ব্যাংক থেকে ব্যবসা পরিচালনার জন্য নিয়ম মেনে বিভিন্ন সময়ে ঋণ গ্রহণ করেছে বেক্সিমকো এবং শর্ত মেনে সেইসব ঋণ পরিশোধও করে যাচ্ছে। সমপ্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ সীমার বিষয়ে মোট মূলধনের পরিবর্তে পরিশোধিত মূলধন বিবেচনায় এনে নতুন একটি নিয়ম বাস্তবায়ন করে। যার ফলে আগের নিয়মে বেক্সিমকো এবং অন্যান্য আরও প্রতিষ্ঠানকে প্রদানকৃত ঋণ নিয়ে জটিলতা শুরু হয়। সেই জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এই সমস্ত ঋণকে নতুন নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য সময় বেঁধে দিয়ে সাময়িক অব্যাহতি দেয়।