যেসব এমপি গত কয়েক বছরে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেছেন তাদের একটি তালিকা তৈরি করছে আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে ওই তালিকা তৈরির কাজ করছেন দলটির সাংগঠনিক সম্পাদকরা। তাদের সঙ্গে রয়েছেন কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যও। দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের দেয়া অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এক্ষেত্রে সাংগঠনিক নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিতর্কিত এমপি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা মানবজমিনকে বলেন, আগামী নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। যার জনপ্রিয়তা রয়েছে কেবল তাকেই দলীয় মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এজন্য বিতর্কিত নেতাদের বাদ দেয়ার ঘোষণা দলীয় সভাপতি আগেই দিয়েছেন। এমনকি তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কারেরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
দলীয় নেতারা জানান, গত কয়েক মাসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ও ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা থেকে অসংখ্য চিঠি এসেছে স্থানীয় এমপিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে। এরমধ্যে যেগুলো যৌক্তিক সেগুলোকে আমলে নেয়া হচ্ছে।
বিশেষ করে যেসব সংসদ সদস্য সাংগঠনিক বিষয়গুলো না মেনে নিজের মতো করে দলে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের আগে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয় গুরুত্বসহকারে দেখা হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দশম জাতীয় সংসদের ৫৬ জন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী দলের মনোনয়ন পাননি। এর আগে একইভাবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৪৯ জন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। ৬ই আগস্ট গণভবনে আয়োজিত বিশেষ বর্ধিত সভায় মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তৃণমূলের নেতারা। তারা অভিযোগ করেন, অনেক এলাকায় মন্ত্রী-এমপিরা দলের বাইরে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। তারা দলীয় নেতাকর্মীদের খুব একটা মূল্যায়ন করেন না। এ ছাড়া সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও তারা নেতাকর্মীদের পরামর্শকে গুরুত্ব দেন না। এসব কারণে অনেক জায়গায় দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ অসন্তুষ্ট। যা আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ বর্ধিত সভায় সারা দেশ থেকে পাঁচ হাজারের মতো প্রতিনিধি অংশ নেন। সভায় উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের ৪৩ জন নেতা বক্তব্য রাখেন।
তারা বলেন, পক্ষপাতপূর্ণভাবে টিআর-কাবিখা দিয়ে অনেক এমপি এলাকায় বদনাম করছেন এবং তারা মাই লীগ তৈরি করেছেন। শেখ হাসিনার মনোনয়ন পেয়ে অনেকে শেখ হাসিনার চেয়ে নিজেকে জনপ্রিয় মনে করেন বলেও মন্তব্য করেছেন তৃণমূলের অন্তত দুজন নেতা। তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, কিছু কিছু এমপি টিআর-কাবিখা নিয়ে অনিয়ম করেন, দুর্নীতি করেন। টাকা খেয়ে কোনো কোনো এমপি বিএনপি-জামায়াতের জন্য চাকরির সুপারিশ করেন। ফলে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। তৃণমূলের একাধিক নেতা আওয়ামী লীগের অন্তঃকলহ এবং বিভক্তির জন্য এমপিদের ভূমিকাকে দায়ী করেন। এইসব এমপিদের বিরুদ্ধে তৃণমূলের নেতারা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতিকে আহ্বান জানান। এরপরই ১২ই আগস্ট গণভবনে অনুষ্ঠিত হয় দলটির ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, দলের উন্নয়ন প্রচার না করে এমপি কী করলো, সেটা নিয়ে লেগে থাকেন। এতে দলের বদনাম হয়। আমি পরিষ্কারভাবে বলছি, কাকে মনোনয়ন দেবো, সেটা জরিপ করে দেখছি। এখনো জরিপ চলছে। কিন্তু যারা এমপিদের বিরুদ্ধে বলে, দলের বিপক্ষে বলে, তাকে মনোনয়ন দেবো না। তিনি বলেন, যারা এমপি ও দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বলে ভবিষ্যতে তাদেরকে দলে রাখবো কিনা সেটাও ভেবে দেখবো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিশেষ বর্ধিত সভার পরই দলীয় সভাপতি এমপিদের বিষয়ে খোঁজ নেয়ার নির্দেশ দেন। তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পাওয়া গেছে এমপিদের বিরুদ্ধে। তাই আগামী নির্বাচনে কতোজন এমপি আবারো মনোনয়ন পাবেন তা নির্ভর করছে শেখ হাসিনার ওপর। কারণ দলীয় সভাপতি সব এমপিদের আমলনামা খতিয়ে দেখছেন। যারা সাংগঠনিক নির্দেশনা মেনে দল পরিচালনা করেছেন তাদের মনোনয়ন নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু যেসব এমপি দলের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য তৈরি করেছেন তাদের কপাল পুড়বে এটা অন্তত নিশ্চিত। তবে সেই সংখ্যাটা কতো হতে পারে তা কেবল দলীয় সভাপতিই বলতে পারবেন বলে মন্তব্য করেন তারা। বিতর্কিত সংসদ সদস্যদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গণমাধ্যমকে বলেন, আইনপ্রণেতাদের একটি অংশের পতনের বিষয়ে তারা অবগত আছেন। আমরা তাদের পরিবর্তে তরুণ, সৎ, নিবেদিতপ্রাণ ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দেবো। এবার দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তাই হবে প্রধান মাপকাঠি।