একের পর এক ভূমিকম্পে কাঁপছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল। সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক, সিরিয়ার পর মরক্কোতে ঘটল ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। বাংলাদেশেও কিছুদিন পরপরই ছোটখাটো ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে। এই অবস্থায় ভূ-তত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশও বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। যে ভূমিকম্পের মাত্রা হতে পারে রিখটার স্কেলে ৮ এর বেশি। এতে সিলেট-চট্টগ্রাম ছাড়াও সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে রাজধানী ঢাকা।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ইন্ডিয়া প্লেট, বার্মা প্লেট ও এশিয়া প্লেট। উত্তরে এশিয়া, পশ্চিমে ইন্ডিয়া ও পূর্বে বার্মা প্লেট। ইন্ডিয়া প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। সুনামগঞ্জ কিশোরগঞ্জ হাওড় হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে এই সাবডাকশন প্লেট। এটাকে ভূতত্ত্ববিদরা সাবডাকশন জোন বলেন। সাবডাকশন জোনের প্লেটগুলো খুবই বিপজ্জনক। যা খুবই শক্তিশালী এবং জানমালের বেশি ক্ষয়ক্ষতি করে। ওই গবেষণার সময় ২০০৩ সাল থেকে ২০০৭ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ২৫টির মতো জিপিএস বসানো হয়। তার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ভূ-তত্ত্ববিদরা দেখতে পান, যে এই সাবডাকশন জোনে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রা শক্তি জমা হয়ে আছে। এই শক্তি যে কোনো সময়ে বের হয়ে আসতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বড় ভূমিকম্প হওয়ার মতো দুটি উৎস রয়েছে। এর একটি হচ্ছে ডাউকি ফল্ট এবং অন্যটি হলো সাবডাকশন জোন উত্তরে সিলেট থেকে দক্ষিণে কক্সবাজার, টেকনাফ। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো এ সাবডাকশন জোন।
এই সাবডাকশন জোনে গত ৮০০ থেকে হাজার বছরে কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি। এর দক্ষিণে টেকনাফ থেকে মিয়ানমার অংশে ১৭৬২ সালে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। সেই ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন ডুবন্ত দ্বীপ তিন মিটার ওপরে উঠে আসে। তাছাড়া সীতাকুণ্ড পাহাড়ে কাদাবালুর উদগীরণ হয়। সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এলাকায় যে শক্তি জমা হয়ে আছে তার এখন পর্যন্ত বের হয়নি। সেটাই হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত।
ভূতত্ত্ববিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, যে কোনো জায়গায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আগ দিয়ে ছোটখাটো কিছু ভূমিকম্প হয়। আবার হঠাৎ করে একবারও শক্তি বের হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ছোটখাটো ৫টি ভূমিকম্প হয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। সবগুলোই সাবডাকশন জোনের মধ্যে পড়েছে। এগুলো বড় ভূমিকম্প হওয়ার আলামত। তিনি বলেন, সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সাবডাকশন জোনে ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়ে আছে। যে কোনো সময় সে শক্তি বের হয়ে আসতে পারে।
এই শক্তি একবারে বের হতে পারে, আবার ধাপে ধাপেও বের হতে পারে। রাজধানী থেকে উৎসস্থল ডাউকি ফল্টের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার এবং ভারত ও বার্মা প্লেটের সাবডাকশন জোনের দূরত্ব অন্তত ৭০ কিলোমিটার।
কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হবে ঢাকাতে। ঢাকা হচ্ছে দেশের সবচেয়ে জনবহুল নগরী। আর এখানকার নগরায়ণ অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিত। অনেক কাঠামোও দুর্বল। যেখানেই জনসংখ্যা খুব বেশি, ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ঝুঁকি বাড়ানোর জন্য যে যে উপাদানগুলো প্রয়োজন সবই ঢাকায় বিদ্যমান। সেদিক থেকে ঢাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে ঢাকা নগরীর যে ক্ষয়ক্ষতি হবে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে ।
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরের দুর্বল কাঠামো এবং সরু রাস্তা ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় সচেতনতার বিকল্প নেই। স্ব স্ব জায়গা থেকে প্রত্যেককেই ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে জানতে হবে।