ডলার সাশ্রয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানামুখী উদ্যোগ নেয়ায় অর্থবছরের শুরুতে কমেছে বাণিজ্য ঘাটতি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে বাণিজ্য ঘাটতি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। সেই সঙ্গে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যের ঘাটতি কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল মঙ্গলবার যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, জুলাইতে পণ্যবাণিজ্য ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ৬৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বাণিজ্য ঘাটতির এই পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৬৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই মাসে ঘাটতির অঙ্ক ছিল ২০৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭১৬ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের রেকর্ড ৩ হাজার ৩২৪ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি এবং বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে ১ হাজার ৮৬৯ কোটি ডলারের ঘাটতি নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর শুরু করেছিল বাংলাদেশ। এই প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের জুলাই থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার প্রভাবে চলতি হিসাব ভারসাম্যের ঘাটতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়। এরপর সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় অনেকাংশে কমে এসেছে। আবার একই সময়ে রপ্তানি আয়ও আগের চেয়ে বেড়েছে। উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের ছাড়ও বেশ বেড়েছে। সব মিলিযে বাণিজ্য ঘাটতি কমতে শুরু করেছে। এর পাশাপাশি চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিবর্তে উদ্বৃত্ত দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের কিস্তি ছাড়, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ আরও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণের অর্থ পাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি কমে এসেছে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে রপ্তানি আয়ে যে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি তৈরি হয়েছে, সেটা যদি অব্যাহত থাকে এবং প্রবাসী আয় কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ে, তা হলে আগামীতে বাণিজ্য ঘাটতি আরও কিছুটা কমতে পারে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থবছরের শুরুতে বাণিজ্য ঘাটতি কমে যাওয়া ভালো দিক। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে পণ্য আমদানি ব্যয় কমেছে। সে কারণে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি কমেছে। তবে ডলারসংকট কিন্তু কাটেনি। ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। এ জন্য সরকারকে রিজার্ভ বাড়ানোর দিকেই এখন সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই শেষে ৪৯৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ৯২ শতাংশ কম। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ৪৩৫ কোটি ডলারের পণ্য, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। এতে করে বাণিজ্য ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ৬৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পণ্য আমদানির জন্য চলতি অর্থবছরের আগস্টে ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। আগের মাস জুলাইয়ে এর পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। তবে আগস্টের এলসি খোলার পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে সাড়ে ১৬ শতাংশ কম। ২০২২-১৩ অর্থবছরের আগস্টে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকাররা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে ব্যবসায়ীদের জন্য পণ্য আমদানির এলসি খোলা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিছু পণ্য আমদানিতে ১০০ শতাংশ মার্জিন রেখে তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এলসি খোলার ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানোয় ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচার কমেছে। ফলস্বরূপ সার্বিকভাবে এলসির পরিমাণও কমেছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাণিজ্য ঘাটতি কমে যাওয়ায় চলতি হিসাবের ভারসাম্যও ইতিবাচক হয়ে গেছে। চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিবর্তে উদ্বৃত্ত দেখা গেছে। জুলাই মাসে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ৫৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে, যা আগের বছরে একই সময়ে ৪৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল।
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা
চলতি হিসাবের ভারসাম্য উদ্বৃত্ত থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কোনো দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি হলে আর সেই সঙ্গে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। এতে তাদের বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ কারণেই চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হলে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি কমেছে
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০৬ কোটি ৭০ ডলার। এই সূচকটিতে আগের বছর একই সময় ঘাটতি ছিল ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। তাই দেখা যাচ্ছে, সামগ্রিক লেনদেনেও (ওভারঅল ব্যালান্স) ঘাটতি কিছুটা কমেছে।
এর আগে, রিজার্ভ কমে আসা এবং চলতি হিসাবে রেকর্ড ঘাটতির মধ্যে সরকার বাজেট সহায়তাসহ আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারী সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী ও দেশের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করে। এর অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার। এটির প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকেই পেয়েছে বাংলাদেশ। কিস্তিতে অবশিষ্ট অর্থ পাওয়া যাবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাজেট সহায়তার অংশ হিসেবে ৫০৭ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। এডিবি, জাইকাসহ আরও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণে অর্থ পাওয়ার আশায় রয়েছে বাংলাদেশ। এসব অর্থ ছাড় হলে চলতি হিসাবের ঘাটতি আরও কমে তা ভারসাম্য আনতে সহায়ক হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।